মহামারিতে শিশুদের নিয়ে অতিষ্ঠ কর্মজীবীরা
মাঝে-মাঝে সবকিছুই হাতছাড়া হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এমনটাই বলছিলেন, জার্মান আইনজীবী ক্যাঁথেরিনা বোয়েসে। তিনি তিন সন্তানের মা। করোনা মহামারিতে তার মেয়েদের স্কুল ১৪ মাস ধরে বন্ধ থাকার পর আবারও ছুটি বেড়েছে।
জার্মানির এই আইনজীবীর রাত জেগে কাজ করার অভ্যাস। প্রায়ই তিনি রাত চারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত কাজ করেন। ওই সময়ে তার ঘরটা একেবাবেই নীরব থাকে। তার মেয়েরা অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তিনি মনে করেন, তার ৭ বছরের শিশুটির দিকে একটু বেশি নজর রাখা দরকার। কিন্তু কাজের চাপে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
করোনা মহামরি শুরু হওয়ার পর থেকেই জার্মানির বেশিরভাগ স্কুল ২৯ সপ্তাহের জন্য শিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ কর দেয়। পরে কেউ-কেউ শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জেন্য স্কুল খোলে। কিন্তু জীবনতো তখনও স্বাভাবিক হয়নি। ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মত জার্মানিতেও প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে চার শিশুই বাস করে শহরের বাইরে। সেখানে বেশিরভাগ স্কুলই খোলা রাখা হয়েছে। আবার অনেক শিক্ষার্থী এখনও ভার্চুয়াল ক্লাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।
গত বছর ছিল কর্মজীবী বাবা-মায়ের জন্য হতাশার একটি বছর। এ হতাশায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের পরিবার, তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এমনকি দেশের অর্থনীতিও।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১০ লাখ ৫০ হাজার নারী চাকরি করত। যাদের সন্তানের বয়স ১৩ বছরের মধ্যে। এ সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় বেড়েছে আট শতাংশ।
ইউরোপ ও আমেরিকার বেশিরভাগ শিশু বাবা-মায়ের দ্বৈত-আয়ে বড় হয়। মহামারির আগেও এই ধরণের পরিবারগুলো নিজেদের কাজ ও বাচ্চাদের যত্ন এ দুই নিয়ে লড়াই করত। যদিও স্কুলের ফ্রি চাইল্ড কেয়ার তাদের অনের উপকারে এসেছে। করোনার আঘাতে এ সুযোগটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। স্কুল বন্ধ তো ফ্রি চাইল্ড কেয়ারও বন্ধ।
লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর ফিজিক্যাল স্টাডিজের মতে, ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ব্রিটেনের দম্পতিদের প্রত্যেকে দৈনিক গড়ে ৩.৫ ঘণ্টার বেশি সময় শিশুর যত্ন এবং ১.৭ ঘণ্টা শিশুদের হোম স্কুলিং করাতেন।
মহামারি শুরু হওয়ার আগে রাত ৭টার আগেই বাবা-মায়েদের ১০ জনের সাতজনই ফ্রি হয়ে যেতেন এবং নিজেদের মত করে বিশ্রাম নিতেন ও সময় কাটাতেন। কিন্তু ২০২১ সালের মার্চে দেখা গেল বিশ্রাম নিতে পারা বাবা-মায়েদের সংখ্যা কমেছে। প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজনে গিয়ে দাঁড়ালো এ সংখ্যা। করোনার আঘাতে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ মায়েরা। তাদের ওপর এর প্রভাব প্রায় দ্বীগুণ। এমন পরিস্থিতি এসব বাবা-মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে।
আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, মহামারির মধ্যে যেসব দম্পতির শিশু সন্তান আছে তাদের তুলনা যাদের শিশু সন্তান নেই তাদের কম মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হয়েছে। একই সঙ্গে সংস্থাটি বলছে, শিশুদের সঙ্গে বসবাসের কারণে কোভিডের আগে বাবা-মায়েদের মধ্যে এধরণের মানসিক-স্বাস্থ্যগত ঝুকি ছিল না। মহামারির সময় বাবা-মায়েদের মধ্যে উদ্বেগ, একাকীত্ব, আর্থিক চাপ এবং হতাশার লক্ষণগুলি দেখা দিয়েছে।
শিশুদের ভার্চুয়াল স্কুলিং বা শিক্ষা কার্যক্রম সামলানো অনেকের জন্য চ্যালেঞ্জ। একটি ব্রিটিশ প্যারেন্টিং ফোরাম তাদের একটি পোস্টারে অনলাইন স্কুলিংয়ের সমালোচনা করেছে। তাদের একজন বলেন, তার বাড়িতে যে কম্পিউটারটি আছে তাতে ক্যামেরা নেই। তার আইপ্যাডে ক্যামেরা আছে কিন্তু ঠিকমত কাজ করছে না। তার অফিস থেকে দেয়া কম্পিউটারটিতেও সন্তানের ভার্চুয়াল স্কুলিংয়ের জন্য ব্যবহৃত সব অ্যাপ কাজ করে না। তার মতে ভার্চুয়াল স্কুলিং অনেকটাই চ্যালেঞ্জ। এভাবে অনেকে সন্তানদের নিয়ে নিজেদের অনুভূতি জানিয়েছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে আরেকটি মারাত্মক উদাহরণ। সেখানকার স্কুলগুলো গত বছর মাত্র পাঁচ সপ্তাহের জন্য বন্ধ ছিল। ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা শুরুতে বেশ কয়েকদিন ভার্চুয়ালি ক্লাস করেছে। কিন্তু কিছুদিন পর ভার্চুয়াল ক্লাসে তাদের আগ্রহ কমে যায়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় দুই সন্তানের মা কিম না-ইওন বলেন, সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে চলমান অনিশ্চয়তা। গত মার্চ মাসেও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কোরিয়ান বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করতেন। যদিও এখন তার সংখ্যাটা কিছুটা কমেছে।
তবে হতাশার মধ্যেও সুখবর। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের বাসিন্দা অ্যালিসা জানিয়েছেন তার সন্তানদের স্কুল খুলেছে। শিশুরা সপ্তাহে চারদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সকাল সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত স্কুল করছে। এরপর বাড়ি ফেরে। যদিও বাকি থাকে অনলাইন ক্লাস। অ্যালিসা কৃতজ্ঞ তার সন্তানদের স্কুলের সময়সূচি নিয়ে এবং তিনি ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করছেন।