January 20, 2025
আঞ্চলিকলেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

মশিয়ালীর মূর্তিমান আতঙ্ক জাকারিয়া-জাফরিন-মিল্টন

একাধিকবার গ্রেফতার হলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যান তাদের সহযোগীরা

জয়নাল ফরাজী
খুলনার খানজাহান আলী থানার মশিয়ালী গ্রাম। যেখানে গত বৃহস্পতিবার রাতে গুলি করে হত্যা করা হয় তিনজনকে। আর এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর গণপিটুনীতে মারা যান এক ব্যক্তি। নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উঠে এসেছে তিন ভাই শেখ জাকারিয়া হাসান, শেখ মিল্টন হাসান ও শেখ জাফরিন হাসানের নাম। যাদের ছোঁড়া গুলিতেই নিহত হন ওই তিন ব্যক্তি দাবি এলাকাবাসীর।
খুলনা মহানগরীর আটরা-গিলাতলা ইস্টার্ণ গেট এলাকায় ওই তিনভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। অসামাজিক কার্যকলাপ, এলাকায় প্রভাব বিস্তার, জবর দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এলাকাবাসীর কাছে তারা মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত। যার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পান না।
শেখ জাকারিয়া খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক ছিলেন। হামলার পর তাঁকে ওই পদ থেকে বহিষ্কার করেছে থানা আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ছোট ভাই জাফরিন খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
তাদের বাবা মৃত শেখ হাসান আলী খুলনা সরকারি বিএল কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। এলাকায় তিনি সম্মানিত ও প্রভাবশালী মানুষ বলে গণ্য ছিলেন। বছর কয়েক আগে বাবা হাসান আলী দ্বিতীয় বিয়ে করায় বাবাকেও কুপিয়ে জখম করেছিলেন ছেলেরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই তিনভাই শুধু অবৈধ অস্ত্রধারীই ছিলেন না; অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসাও ছিল তাদের। এলাকার তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অস্ত্র উচিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতেন তারা। অন্ধকার জগতের মানুষ হওয়ায় সমাজের সম্মানজনক পদ-পদবী যাতে পেতে না পারে সেজন্য এলাকার মুরব্বীরা বিরোধিতা করতেন। এতে ক্ষুব্ধ ছিল তারা। বাড়ীতে টর্চারসেল রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। কথা-কাজে একমত হতে না পারলে ধরে এনে সে কক্ষে করতো নির্যাতন। এছাড়াও প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ছবি তুলে নিজেদের ফুটিয়ে তুলতেন, যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন তারা খুবই প্রভাবশালী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ আগে থেকেই ওই এলাকায় সুদের ব্যবসা করতেন জাকারিয়া, মিল্টন ও জাফরিন। টাকা দেওয়ার সময় সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হতো। সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে কেড়ে নেওয়া হতো দোকান, ঘরবাড়ি। রোজার সময় ওই এলাকায় বাবুল শেখ নামের একজন একটি দোকান দেন। ওই দোকানের জন্য তাঁর কাছে চাঁদা দাবি করেন জাকারিয়া। চাঁদার টাকা না দেওয়ায় লোকজন নিয়ে দোকান ভাঙচুর ও মালামাল লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ঘটনার পর থেকেই ফুঁসে ছিলেন এলাকাবাসী।
ওই এলাকার মসজিদ ও মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন শেখ জাকারিয়া। গত ৩০ জুন ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। বাবুলের দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করার অভিযোগে এলাকাবাসী এবার ওই কমিটি থেকে জাকারিয়াকে বাদ দিতে চাইছিলেন। শুক্রবার পুরোনো কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করার কথা ছিল। এটা নিয়েও এলাকাবাসীর সঙ্গে জাকারিয়া ভাইদের বিরোধ চরম মাত্রায় পৌঁছায়।
ওই বিরোধ থেকেই গত বৃহস্পতিবার মুজিবর রহমানকে ডেকে নিয়ে হাতে অস্ত্র দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। রাত সাড়ে আটটার দিকে এরই প্রতিবাদ করতে গিয়ে জাকারিয়া ভাইদের হামলার শিকার হন তাঁরা।
সম্প্রতি জাফরিনের চাঁদাবাজির খপ্পরে পরেন মশিয়ালী এলাকার রাসেল। তাদের হাত থেকে বাঁচতে কিছুদিন এলাকা ছাড়া ছিলেন। বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর তিনি এলাকায় এসেছেন। আজ শনিবার এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় তার।
তিনি দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিনকে জানান, কিছুদিন আগে তাকে সন্দেহভাজন একটি ঘটনায় পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। পরিবারের লোকজন থানায় গিয়ে কথা বলে তাকে ছাড়িয়ে আনে। এ ঘটনা শুনে জাফরিন তার কাছে এসে মোটরসাইকেলে করে একটি অনলাইন টিভি’র সম্পাদকের কাছে নিয়ে যান। সেখানে ক্যামেরায় তার জবানবন্দি রেকর্ডিং করা হয়, জাফরিন শিখিয়ে দেন বলতে- ২৮ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে ছাড়া হয়েছে। যা রেকর্ডিং করে রাখা হয়। এরপর জাফরিন তার কাছে টাকা দাবি করেন, না হলে ওই ভিডিও ইন্টারনেট এ ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানান। শেষমেষ ওই চক্রের হাত থেকে বাঁচতে বেশ কিছুদিন তিনি পালিয়ে ছিলেন।
তিনি আরও জানান, জাফরিন একা নন। অনেকেই তাদের চক্রের সাথে জড়িত। অপকর্ম করে জাফরিন ধরা পরে কিছুদিন পর জেল থেকে বের হয়ে আসেন। কিন্তু তার সহযোগীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। অনেকেই ওই তিনভাইয়ের অপকর্মে সহযোগিতা করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন বলেও তিনি জানান।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) কানাই লাল সরকার দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিনকে জানান, মশিয়ালীর তিন খুন ও গণপিটুনীর ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- অন্যতম হোতা শেখ জাফরিন হাসান, শেখ জাকারিয়ার শ্বশুর কোরবান আলী, শ্যালক আরমান ও সহযোগী জাহাঙ্গীর। বাকিদের গ্রেফতারের জন্যও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ এম জে এফ

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *