মধ্য আকাশে বেলারুশের সাংবাদিক যখন বুঝলেন, তার সময় ফুরিয়ে আসছে
লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসের দিকে যাচ্ছিল রায়ানএয়ারের ফ্লাইট ৪৯৭৮। কিন্তু হঠাৎ করেই পাইলটের ঘোষণা, পাশের দেশ বেলারুশের রাজধানী মিনস্কের দিকে ঘোরানো হচ্ছে বিমানের গতিপথ।
গ্রিস থেকে লিথুয়ানিয়াগামী উড়োজাহাজটি এমন আচমকা ঘুরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা তখনও দেওয়া হয়নি। তবে বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজটির একজন যাত্রীর মধ্যে তড়িৎ প্রতিক্রিয়া হল।
তিনি আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে মাথার ওপরের লকারে থাকা লাগেজ থেকে ল্যাপটপ বের করে বাড়িয়ে দিলেন পাশের নারী সঙ্গীর দিকে। সঙ্গে দিলেন মোবাইল ফোনটিও।
বেলারুশের ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক রোমান প্রোতেসেভিচের হাতে সময় খুব বেশি ছিল না। লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াস থেকে মিনস্কের দূরত্ব দুশো কিলোমিটারেরও কম। ঘুরে যেতে লাগবে মাত্র কয়েক মিনিট।
গতবছর মিনস্কে প্রবল সরকারবিরোধী বিক্ষোভের খবর প্রচার করায় বেলারুশ সরকারের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় রয়েছ রোমান প্রোতেসেভিচের নাম। তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য রোববার রীতিমত সিনেমার কায়দায় জঙ্গি বিমান পাঠিয়ে রায়ানএয়ারের ওই উড়োজাহাজকে মিনস্কে নামতে বাধ্য করেছে বেলারুশ সরকার, যা নিয়ে চলছে তুমুল সমালোচনা।
ওই ফ্লাইটের যাত্রীদের বরাতে সাংবাদিক রোমান প্রোতেসেভিচের গ্রেপ্তারের ঘটনা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে।
ওই ফ্লাইটের লিথুয়ানিয়ার যাত্রী মান্তাস বলেন, “যখন ঘোষণা হল যে আমরা মিনস্কে অবতরণ করতে যাচ্ছি, রোমান দাঁড়িয়ে গেলেন এবং লাগেজ কম্পার্টমেন্ট খুলে লাগেজ থেকে বিভিন্ন জিনিস আলাদা করতে শুরু করলেন।”
“আমি মনে করি, উনি ভুল করেছেন। জিনিসগুলো বান্ধবীকে না দিয়ে আমাকে নয়তে অন্য কোনো যাত্রীকে দিতে পারতেন, আমরা অনেক লোক ছিলাম। আমারতো মনে হয় তাকেও (বান্ধবী) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
পাশেই তখন উড়ছে সোভিয়েত যুগের একটি মিগ-২৯। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কা ওই যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছেন রায়ানএয়ারের উড়োজাহাজটিকে মিনস্কে নামিয়ে আনতে।
গ্রিসের রাজধানী এথেন্স থেকে যাত্রা শুরুর পর মিনস্কে সাত ঘণ্টার বিরতি আর ভোগান্তি শেষে লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে ফিরে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলছিলেন মান্তাস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্লান্ত হয়ে পড়া আরেকজন যাত্রী বলেন, প্রোতেসেভিচকে ‘অত্যন্ত আতঙ্কিত’ দেখাচ্ছিল।
“আমি সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়েছি এবং তিনি খুবই হতাশ ছিলেন।”
বেলারুশের রাষ্ট্রীয় বার্তাসংস্থা বেলারুশিয়ান টেলিগ্রাফ এজেন্সি- বেলটা বলেছে, বোমা থাকার সন্দেহে রায়ানএয়ারের ওই ফ্লাইটের গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য ওই বোমার খবর মিথ্যা হয়ে যায়।
একা দাঁড়িয়ে রোমান প্রোতেসেভিচ
মিনস্কে অবতরণের পর ২৬ বছর বয়সী সাংবাদিক রোমান প্রোতেসেভিচকে দ্রুততার সঙ্গে আলাদা করে অনুসন্ধানী কুকুর দিয়ে তার লাগেজ তল্লাশি করা হয়। অবশ্য সেখানে কিছু পায়নি পুলিশ।
ওই ফ্লাইটের যাত্রী মান্তাস বলেন, “আমরা দেখেছি রোমান প্রোতেসেভিচকে লাগেজে কিছু খোঁজার জন্য আটকানো হয়েছে।”
অন্য যাত্রীদের লাগেজেও তল্লাশি শেষে বাসে করে টার্মিনালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে আবারও বিমানে ওঠার আগ পর্যন্ত তাদের সেখানে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে।
“আমরা জানালা দিয়ে দেখলাম, রোমান একা দাঁড়িয়ে আছেন এবং অনুসন্ধানী কুকুরসহ একজন পুলিশ (তার লাগেজে) কিছু খুঁজছে।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও একজন যাত্রী লিথুয়ানিয়ার গণমাধ্যমকে বলেছেন, বেলারুশের নিরাপত্তাকর্মীরা আসার পর রোমান প্রোতেসেভিচ নিজেই তার পরিচয় দেন।
“আমি তার পাসপোর্ট নিয়ে যেতে দেখেছি। তিনি মাস্ক খুলে বলেন: আমি অমুক এবং আমার কারণেই এসব কিছু ঘটছে।”
ভিলনিয়াসে পৌঁছানোর পর বিমানের যাত্রীদের ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। তারা জানালেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর মিনস্ক থেকে আবারও উড়োজাহাজে ওঠার আগে লাগেজ এবং পাসপোর্ট পরীক্ষার জন্য তাদের কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।
মান্তাস জানান, রোমান প্রোতেসেভিচের কাছ থেকে ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন নিয়েছিলেন তার যে সঙ্গী, তাকে মিনস্কে আটক করা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। তবে মিনস্ক থেকে ভিলনিয়াসে যাত্রার আগে উড়োজাহাজটিতে যাত্রী ছিল আগের চেয়ে কম।
“তার মানে বিমান থেকে একজনের বেশি লোককে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে- কিন্তু সেটা সঠিক করে বলা মুশকিল।”
লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট গিতানাস নাউসেদা অবশ্য এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মিনস্ক থেকে ভিলনিয়াসের ফ্লাইটে প্রোতেসেভিচের নারী সঙ্গী ওঠেননি।
বেলারুশের বিরুদ্ধে নিন্দা
সাংবাদিক রোমান প্রোতেসেভিচকে গ্রেপ্তারের জন্য রায়ানএয়ারের ফ্লাইট ঘুরিয়ে দিতে বাধ্য করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
অবিলম্বে প্রোতেসেভিচের মুক্তি দাবি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। লিথুয়ানিয়ার আহ্বানে ইউরোপীয় নেতারা সোমবার এ বিষয়ে একটি বৈঠকেও বসবেন।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের এক টুইটে বলেন, “গর্হিত এবং বেআইনি আচরণের জন্য বেলারুশকে পরিণতি ভোগ করতে হবে। রায়ানএয়ার হাইজ্যাকের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করা হবে।”
এই ঘটনাকে ‘রাষ্ট্রীয় হাইজ্যাক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতায়ুজ মোরাভিয়েস্কিও।
লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, “পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর জঘন্যভাবে আক্রমণ করা হয়েছে এবং তার কঠোরতম জবাব দেওয়া হবে।”
ইউরোপীয় ২৭ দেশের জোট ইইউকে বেলারুশের আকাশ সীমা পরিহার করার একটি যৌথ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে লিথুয়ানিয়া। সেইসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অথরিটিকে বেলারুশের সদস্যপদ বাতিলেরও দাবি জানানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন এক টুইটে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেক ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়ে বলেন, “বেলারুশ কর্তৃপক্ষ একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের জন্য নির্লজ্জ ও জঘন্যভাবে একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটকে ঘুরিয়ে নিয়েছে।
“আমরা এর আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করছি এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে আমরা বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।”
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব টুইটার বার্তায় বলেন, “জোটের দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করছে” যুক্তরাজ্য। “লুকাশেঙ্কোর এমন অস্বাভাবিক আচরণের জন্য কঠিন পরিণতি হবে।”
৬৬ বছর বয়সী আলেকজান্দার লুকাশেঙ্কো ১৯৯৪ সাল থেকে বেলারুশ শাসন করছেন। গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় শত শত বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নির্বাসনে থাকা বেলারুশের বিরোধীদলীয় নেত্রী সেভেৎলানা তিখানোভস্কায়াও জোর করে রায়ানএয়ারের ফ্লাইট নামানোর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং সাংবাদিক প্রোতেসেভিচের মুক্তি দাবি করেছেন।
গত বছর বেলারুশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর দেশত্যাগে বাধ্য হন সেভেৎলানা তিখানোভস্কায়া। বর্তমানে তিনি লিথুয়ানায় অবস্থান করছেন।
তিনি বলেছেন, প্রোতেসেভিচকে একজন সাংবাদিক, ব্লগার, ফটোগ্রাফার এবং আন্দোলনকর্মী। ২০১৯ সালে তিনি বেলারুশ ছেড়ে চলে যান এবং ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করেন।
এরপরই বেলারুশে তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। রোমান প্রোতেসেভিচকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেওয়া হয় এবং বেলারুশে তিনি মৃত্যুদণ্ডের মুখে আছেন।