ভ্যাকসিনের সফলতা নিয়ে খোদ হু’র প্রধান বিজ্ঞানীর সংশয়!
কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের সময়ের নজিরবিহীন এক সঙ্কট। এটি মোকাবিলায় বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় মাত্র ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে একটি ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্যে নজিরবিহীন গতিতে কাজ করছে। সাধারণত ভ্যাকসিন তৈরির এ কাজ করতে ৫ থেকে ১০ বছর সময়ের দরকার হয়।
গত বছরের ডিসেম্বরে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের উৎপত্তি হওয়ার পরপরই বিজ্ঞানীরা এর আণবিক গঠন আবিষ্কার এবং অসাধারণ কিছু কাজ শুরু করেন। জানুয়ারির মাঝে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন, জেনেটিক সিকোয়েন্স বুঝতে পারেন। পরে এই সিকোয়েন্স বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান ভ্যাকসিন তৈরির প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করেন তারা।
ভাইরাসটি শনাক্তের মাত্র দুই মাস পর মানবদেহে এর ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়।
ভ্যাকসিন তৈরির বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় জড়িত কারা?
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে দুই শতাধিক ভ্যাকসিন তৈরির বিভিন্ন ধাপে রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২৪টি মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রচুর আন্তর্জাতিক পারস্পরিক সহযোগিতা চলছে। শুধু তাই নয়, একাডেমিক গ্রুপগুলোও ছোট ছোট বায়োটেকের সঙ্গে সমন্বয় করছে, ছোট বায়োটেকরা বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করছে। এমনকি বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোও একে অপরের সঙ্গে প্যাটেন্টকৃত প্রযুক্তি ভাগাভাগি করছে।
কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড ইনোভেশন (সিইপিআই) এবং ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভির সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিনের এক বৃহৎ প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে ভ্যাকসিন পিলার হিসেবে কোভ্যাক্স নামে এই প্রচেষ্টা চালু আছে। ফাস্ট-ট্র্যাক গবেষণা এবং কোভিড ভ্যাকসিন তৈরি করতে বিশ্বজুড়ে অনেক দাতা দেশ এবং বিভিন্ন অংশীদারকে একত্রিত করছে তারা।
যেসব ভ্যাকসিন পরীক্ষাধীন তার মধ্যে অন্যতম— ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিম্পাঞ্জির অ্যাডেনোভাইরাসভিত্তিক ভ্যাকসিনটি, যা এর আগে ইবোলার ভ্যাকসিন তৈরির সময় ব্যবহৃত হয়েছিল; চীনের অন্য একটি ভ্যাকসিনও অ্যাডেনোভাইরাস প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে; যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মডার্নার তৈরি আরএনএ ভ্যাকসিন ও রাশিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল এবং অন্যান্য দেশের কয়েকটি।
উপযুক্ত ভ্যাকসিন খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়া
একটি ভ্যাকসিন ট্রায়ালের প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন ধাপ সংশ্লিষ্ট। এর শুরু হয় ল্যাবরেটরিতে গবেষণা এবং প্রাণীর দেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের মাধ্যমে; তার পরই মানবেদহে পরীক্ষা চালানো হয়। এখানে প্রথম ধাপের পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে ভ্যাকসিনের সুরক্ষা যাচাই করা হয়। ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কিনা এবং অপ্রত্যাশিত কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ জন মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়।
এগুলো পরিষ্কার হওয়ার পর দ্বিতীয় ধাপে যায়—এটি একটু বড় পরিসরের পরীক্ষা। এ ধাপে ভ্যাকসিনটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানবদেহে ইউমিনিটি বৃদ্ধি অথবা প্রত্যাশিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে কিনা তা জানার চেষ্টা হয়।
এরপর এটি তৃতীয় ধাপের জন্য এগিয়ে নেয়া হয়, এ ধাপে ভ্যাকসিনের সুরক্ষার পাশাপাশি কার্যকারিতা অথবা একজন মানুষকে সংক্রমণ থেকে কতটা সুরক্ষা দেবে তা জানার চেষ্টা করা হয়। ভ্যাকসিনটি লাখ লাখ মানুষের জন্য নিরাপদ হবে কিনা সেটিও এই ধাপে চূড়ান্ত নিশ্চিত হতে হয়।
এসবের পরই কেবল একটি ভ্যাকসিনকে সফল হিসেবে ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স প্রদান এবং জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশের মাঝে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সাধারণত কোনও কোম্পানি ভ্যাকসিন তৈরির পর পরীক্ষার সব ধাপ সম্পন্ন করে। পরীক্ষায় ভ্যাকসিন কাজ করে নিশ্চিত হওয়ার পর তারা এতে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করে, যা করতে এক বছর অথবা তারও বেশি সময়ের দরকার হয়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা হচ্ছে— ভ্যাকসিনের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা; যাতে সময় কম লাগে।
ভ্যাকসিন কীভাবে কাজ করবে?
করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের শরীরে এই রোগটির বিরুদ্ধে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু ইমিউনিটি গড়ে ওঠে। যে কারণে যারা এখনও আক্রান্ত হননি সুরক্ষার জন্য ভ্যাকসিন প্রথমে তাদের দেয়া হবে। এছাড়া যারা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু তাদের শরীরে ইমিউনিটি অথবা এর অ্যান্টিবডি কতদিন টিকে থাকে তা এখনও জানা যায়নি। এর অর্থ হচ্ছে, কিছু মানুষের শরীরে প্রাথমিক ইমিউনিটি আছে, কিন্তু তাদের অ্যান্টিবডি যদি স্থায়ী না হয়, তাহলে এক বছর পর ফের ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া অন্যান্য যারা ভ্যাকসিন পাবেন পরবর্তীতে তাদের শরীরে বুস্টার হিসেবে আরেকটি দেয়া লাগতে পারে।
অন্যান্য ভাইরাসের মতো কোভিড-১৯ বহুবার রূপান্তর ঘটিয়েছে। এটিও ভবিষ্যতে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত ভাইরাসটির ক্রিটিক্যাল অংশ ‘স্পাইক প্রোটিনে’ কোনও মিউটেশন ঘটেনি। এই স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরির লক্ষ্যেই অধিকাংশ ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে। যদি স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশন ঘটে, তাহলে এটি ভাইরাসকে দুর্বল করে ফেলতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে- ভাইরাসটি হয় মানুষকে তেমন সংক্রমিত করতে পারবে না অথবা এটি ভাইরাসকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলবে। তখন ভ্যাকসিন কোনও কাজ করবে না।
সময়ে সময়ে যেহেতু ভাইরাসটি পরিবর্তিত হচ্ছে সেজন্য এটি নিয়ে আমাদের গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে। যে কারণে এ পর্যায়ে এসেও ভ্যাকসিন সার্বজনীন হবে কিনা অথবা একটি ডোজ অথবা প্রত্যেক বছর বা দুই বছর পরপর ভ্যাকসিনটি নিতে হবে কিনা সেটি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া অন্যান্য ফ্লুর মতো এই ভ্যাকসিনেও প্রত্যেক বছর পরিবর্তন আনতে হবে কিনা সেটিও এখন জানা যায়নি। এগুলোই এখন উন্মুক্ত প্রশ্ন।
স্থায়ী টিকা পাওয়া যাবে কখন?
ঐতিহাসিকভাবেই ভ্যাকসিনের মাত্র ১০ শতাংশেরও কম ক্যান্ডিডেট সফলভাবে পরীক্ষা শেষ করতে পেরেছে। যে কারণে ভ্যাকসিন তৈরির ‘অনেক প্রচেষ্টা’ সফলতার সুযোগ বৃদ্ধি করছে। বিশ্বে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টা, প্ল্যাটফর্ম চলমান। এটিই মানুষকে আশাবাদী করে তুলছে যে, বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন সফল হতে পারে।
মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যদি কিছু ভ্যাকসিন কার্যকরী হয়, তাহলে সেগুলো আগামী বছরের কোনও এক সময়ে আসা উচিত। কিন্তু ঠিক কখন আসবে সেটি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুবই কঠিন। খুব বেশি আশাবাদী হলেও সেগুলোর প্রথম ডোজ আগামী বছরের প্রথমার্ধে আসতে পারে।
এটা মনে রাখা জরুরি যে, এমনকি একটি সফল ভ্যাকসিন পাওয়া গেলেও প্রাথমিকভাবে তা সীমিত সংখ্যায় আসবে। সারা বিশ্বের ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য আমাদের ৮০০ অথবা এক হাজার কোটি ডোজ পাওয়া যাবে না। আমরা কয়েকশ মিলিয়ন ডোজ পাবো। সেক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ যারা উচ্চঝুঁকিতে আছেন, যেমন- সম্মুখ সারির কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজসেবী ও অন্যান্যদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।
এরপর ভ্যাকসিনের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি অন্যান্য যেসব ভ্যাকসিন তৈরির বিভিন্ন পর্যায়ে আছে সেগুলো পরীক্ষা করতে হবে। ২০২২ সালের মধ্যে আমরা আরও অনেক বেশি ভ্যাকসিন পেতে পারি বলে আশা করা যেতে পারে।
যদি কখনও ভ্যাকসিন না পাওয়া যায় তাহলে কী হবে?
আমাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অনেকগুলো ভ্যাকসিন তৈরির বিভিন্ন ধাপে রয়েছে। আমরা আশাবাদী যে, একটি অথবা তারও বেশি ভ্যাকসিন কার্যকরী হবে। কিন্তু এই প্রাথমিক প্রচেষ্টা সফল নাও হতে পারে সেজন্যও আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
কোনও ভ্যাকসিন না পাওয়া গেলে এবং ভাইরাসটি যদি উল্লেখযোগ্য মিউটেশন না ঘটায়; তাহলে পর্যাপ্তসংখ্যক মানুষের দেহে ইমিউনিটি গড়ে না ওঠা অথবা অ্যান্টিবডি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সংক্রমণ অব্যাহত থাকতে পারে। এটা হলো হার্ড ইমিউনিটি; যা ভ্যাকসিন প্রয়োগ অথবা প্রাকৃতিক সংক্রমণের মাধ্যমে গড়ে উঠবে। কিন্তু এই হার্ড ইমিউনিটির জন্য কমপক্ষে ৬০-৭০ শতাংশ মানুষকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে হবে।
ভাইরাসটিতে রূপান্তর ঘটলে তা শক্তিশালী অথবা মৃদু হতে পারে। যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে এটি আরও বেশি গতিতে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ এটি দ্রুত রূপান্তরিত হবে এবং আরও অধিকসংখ্যক মানুষকে সংক্রমিত করবে। যদি এটি দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে একই গোত্রের অন্য করোনাভাইরাসের মতো শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাজনিত মৃদু রোগে পরিণত হবে।
কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের উন্নত চিকিৎসা দরকার। যেখানে মানুষের অক্সিজেন দরকার, সেখানে এটি সহজলভ্য করতে হবে। এ জন্য উন্নত নজরদারি এবং আরও ভালো সহায়ক সেবা প্রয়োজন। সুস্থতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে এমন ওষুধ আমাদের আরও বেশি খুঁজতে হবে। অত্যন্ত গুরুতর অসুস্থদের জন্য ডেক্সামেথাসন এবং হাসপাতালে থাকার সময় কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখা রেমডেসিভিরের মতো অন্যান্য ওষুধ খুঁজে বের করতে হবে। ভ্যাকসিন পাওয়ার আগে পর্যন্ত বিকল্প চিকিৎসাগুলো দরকার; যেগুলো মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করতে পারে।
ভ্যাকসিন সহজলভ্য না হওয়া পর্যন্ত করোনা বিস্তারের গতি ধীর করতে বর্তমানে দেশগুলো যেভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের ‘ভ্যাকসিন খুব কাছাকাছি চলে আসছে’ এবং ’এ সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে’ এমন আত্মতুষ্টিতে ভোগা উচিত হবে না। এটা করা যাবে না।