ভোটে অনীহা কেন বিএনপির
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে পুরোপুরি সিদ্ধান্তহীনতায় বিএনপি। দলের সিনিয়র নেতার অনেকেই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় ভোট করতে আগ্রহী। কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ড তা নাকচ করে দিয়েছেন। গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নিয়ে হাইকমান্ড থেকে বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের অধীনে ভোটে গেলে কোনো সুফল আসবে না। সরকারবিরোধী অবস্থান থেকে আন্দোলন প্রক্রিয়ায় সংকটের সমাধান করতে হবে। দলের নবীন নেতা ও সহযোগী সংগঠনগুলো হাইকমান্ডের সঙ্গে একমত। নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একজন নেতা জানান, দলীয় চেয়ারপারসনের বিষয়টি এখনো বিভিন্নভাবে সরকার ঝুলিয়ে রেখেছে। তাঁকে পুরোপুরি কারামুক্ত না করে ভোটে যাওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া বিভিন্ন মামলায় সাজা হওয়ার কারণে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে আসার পরিবেশ নেই। এ অবস্থায় ভোটে গেলে গত নির্বাচনের মতোই ফল হবে; যা বিএনপির জন্য কোনো ইতিবাচক অধ্যায় তৈরি করবে না। এ কারণে বিএনপি রাজপথে থাকার সিদ্ধান্তে একমত রয়েছে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতি দেশের সব রাজনৈতিক দলকে অটল থেকে অতীতের মতো নির্বাচনের ফাঁদে পা না দিতে আহ্বান জানাই।’
বিএনপির যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকারের পতনের লক্ষ্যে বিএনপির আন্দোলন অব্যাহত আছে। জ্বালানি তেল, পরিবহন ভাড়া, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ভোলায় পুলিশ গুলি করে দলের দুজন নেতা নুরে আলম ও আবদুর রহিম হত্যার প্রতিবাদে ২২ আগস্ট থেকে উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ে সভা-সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ সভা-সমাবেশের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে মেসেজ পৌঁছাতে চাই, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। তারেক রহমানসহ দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীর মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। দাবি না মানলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।’বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, তেলের দাম বাড়ানো, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা সামনে রেখে সতর্ক আন্দোলন কর্মসূচিতে থাকবে বিএনপি। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে আন্দোলন ততই বেগবান হবে। এখন মামলায় পড়ে শক্তির ক্ষয় চায় না বিএনপি। এ কারণে হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচিতে আপাতত না গিয়ে শুধু সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ের কথাই তুলে ধরবে দলটি। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীতে করা হবে মহাসমাবেশ। ২২ আগস্ট থেকে থাকবে ধারাবাহিক সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন। শুধু ঢাকা নয়, এরপর জেলা- উপজেলায়ও এ কর্মসূচিগুলো পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি বিশেষ সভা করে চলেছেন মাঠের নেতাদের সঙ্গে।
দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এই সময়ে অনেক ইস্যু পেলেও রাজপথে কার্যত জোরালো আন্দোলন গড়তে ব্যর্থ হয় দলটি। সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই এবার জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে আরও শক্ত অবস্থান গড়তে চায় ঝিমিয়ে পড়া বিএনপি। জনগণের ক্ষোভকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে মাঠ দখলের পরিকল্পনা তাদের। বিশেষ করে রাজধানীর মহাসমাবেশের পর এবার একই ইস্যুতে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চাঙা করার উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। তৃণমূল পর্যায়ে ২২ আগস্ট থেকে ধারাবাহিক সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন করা হবে। এসব কর্মসূচিতে নিজ নিজ জেলা বা সংসদীয় আসনের বিএনপি নেতাদের থাকার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকমান্ড। ঢাকায় অবস্থানরত কেন্দ্রীয় নেতাদের একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য, সারা দেশে আন্দোলনে জোয়ার ছড়িয়ে দেওয়া। সরকারকে হটাতে এক দফা দাবিতে রাজপথে দলের কর্মী-সমর্থক বাড়ানোর চেষ্টা। সঙ্গে তৃণমূলের ঘাঁটি আরও মজবুত করা। সরকারবিরোধী বড় মত তৈরি করা। রাজপথে অলআউট কর্মসূচিতে নামার আগেই বড় আন্দোলনের ওয়ার্মআপ সেরে ফেলতে চায় দলটি।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও নিত্যপণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবনে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতিবাদে শক্তভাবে মাঠে থাকতে চান তাঁরা। এর মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সারা দেশে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের যুক্ততা বাড়ানোই তাঁদের লক্ষ্য। রাজধানীসহ সারা দেশে নেতা-কর্মীদের চাঙাভাব ধরে রাখতে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁদের মাঠে রাখা হবে।
দলীয় সূত্রমতে, ২২ আগস্ট শুরু হওয়া দেশব্যাপী ধারাবাহিক কর্মসূচিতে সংশ্লিষ্ট জেলার সাবেক সংসদ সদস্য ও অতীতে দলের মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের উপস্থিত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারাও নিজ নিজ জেলার কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। জেলা পর্যায়ের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমন্বয় এবং কর্মসূচি কতটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণের জন্য সব বিভাগে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে আলাদা দলও গঠন করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে- আগামী সোমবার প্রতিদিন প্রতিটি জেলা ও মহানগরের কমপক্ষে একটি উপজেলা বা থানায় কর্মসূচি পালিত হবে। উপজেলা, থানা ও পৌরসভার কর্মসূচি ঠিক করবে জেলা কমিটি। ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মসূচি ঠিক করবে উপজেলা, থানা ও পৌর কমিটি। কর্মসূচিতে সহযোগিতা করবে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, সরকারবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। লোডশেডিংসহ গ্যাস সংকটে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। ডিজেল ও সারের দাম বাড়ায় কৃষক দিশাহারা। সাধারণ মানুষের এ ক্ষোভ কাজে লাগাতে হবে। তৈরি করতে হবে বিএনপির প্রতি তাদের আস্থা। মামলা-হামলার ভয় উপেক্ষা করে জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে বিএনপি রাজপথে আছে এমন বিশ্বাস তৈরি করতে হবে। তবে এখনই চূড়ান্ত আন্দোলন নয়। আমাদের কর্মকাণ্ড দেখে একসময় মানুষের আস্থা আসবে এবং তারা রাজপথের আন্দোলনে শরিক হবে। অতীত ইতিহাস বলে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামলে সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন। এ মুহূর্তে আমরা সে কাজটিই করছি। গণদাবির পক্ষে কর্মসূচি নিয়ে কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা ছড়িয়ে পড়ছেন।
বিএনপির মিডিয়া সেল সূত্র জানান, দেশব্যাপী কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের জন্য টিম লিডার হিসেবে ঢাকা বিভাগে দায়িত্বে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, চট্টগ্রামে ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, খুলনায় ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, রাজশাহীতে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, সিলেটে যুগ্মমহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বরিশালে যুগ্মমহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, রংপুরে হারুন অর রশীদ এমপি, ফরিদপুরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমান, ময়মনসিংহে যুগ্মমহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, কুমিল্লায় ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু। খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত শামসুজ্জামান দুদু জানান, কর্মসূচিগুলো যাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়, তার জন্য বিভাগীয় টিম করা হয়েছে। মূলত এ কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মীদের অবস্থান সরেজমিন দেখা, তাঁদের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকলে তা চিহ্নিত করা এবং বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য কর্মীদের প্রস্তুত করাই হবে তাঁদের লক্ষ্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, হাইকমান্ড বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে অনড় রয়েছে। শেষ পর্যন্ত দল নির্বাচনে না গেলে বেশ কিছু শীর্ষ নেতা ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে বিএনপির নেতাদের এমন একটি তালিকা হাইকমান্ডের কাছে রয়েছে।