ভোটের দূষণমুক্ত প্রচারে প্রার্থীদের সঙ্গে ইসির সমঝোতা
সিটি নির্বাচনের সমালোচনা ওঠার পর ঢাকা-১০ আসনে উপনির্বাচনে দূষণমুক্ত প্রচারের লক্ষ্যে প্রার্থীদের সঙ্গে ছয়টি বিষয়ে সমঝোতা করেছে নির্বাচন কমিশন।
এরমধ্যে প্রতি ওয়ার্ডে একটি মাইক ব্যবহার, লেমিনেটেড পোস্টার না সাঁটানো, ২১টি নির্ধারিত জায়গায় পোস্টার সাঁটানো, জনসভা না করে ৫টি শোভাযাত্রা করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও পিডিপির প্রার্থীরা।
একই সঙ্গে ভোটের দিন সাধারণ ছুটি না রাখা এবং মোটর সাইকেল ছাড়া বাকি যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার বিষয়েও কমিশনের সঙ্গে একমত হয়েছেন প্রার্থীরা।
এক মাস আগে ঢাকা সিটির দুই ভাগের ভোটে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণ ও লেমিনেটেড পোস্টারে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার কারণে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন এই উদ্যোগ নিয়েছে ইসি।
২১ মার্চের এই নির্বাচনের ছয় প্রার্থীকে নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা অন্য চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব, রিটার্নিং কর্মকর্তারা মতবিনিময় করেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ঢাকার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা জিএম সাহতাব উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা উভয়পক্ষ সর্বসম্মতিক্রমে ছয়টি বিষয়ে একমত হয়েছি। এ নিয়ে প্রার্থীদের কাছ থেকে স্বাক্ষরও নিয়েছি। দূষণমুক্ত প্রচারের জন্য সমঝোতা সই করেছি।
“আশা করি, নির্ধারিত স্থানে ও নির্বাচনী ক্যাম্পে প্রচার চালালে দুর্ভোগ কমবে নাগরিকদের, উপকৃত হবে সাধারণ জনগণ।”
রোববার নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে প্রার্থীদের সঙ্গে এই মতবিনিময় সভার পর ঢাকা-১০ আসনে উপনির্বাচনে ৬ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে সবাইকে বৈধ ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস পদত্যাগ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় ঢাকা-১০ আসনটি শূন্য হয়েছে।
২৯ ফেব্রুয়ারি প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর ১ মার্চ থেকে শুরু হবে ভোটের প্রচার।
এই নির্বাচনে প্রার্থীরা হলেন- আওয়াগী লীগের মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিএনপির শেখ রবিউল আলম, জাতীয় পার্টির হাজী মো. শাহজাহান, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) কাজী আব্দুর রহীম।
সমঝোতার ছয় বিষয়
>> প্রত্যেক প্রার্থী প্রতি ওয়ার্ডে ১টি করে নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করতে পারবেন এবং ১টি মাইক ব্যবহার করতে পারবেন।
>> প্রার্থী বা তার পক্ষে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নির্বাচনী এলাকায় লেমিনেটেড কোনো পোস্টার টাঙাতে/সাঁটাতে পারবেন না।
>> যত্রতত্র পোস্টার টাঙাতে পারবেন না; পোস্টার সেঁটে দেওয়ার জন্য কমিশন ২১টি জায়গা নির্দিষ্ট করে দেবে। সেখানেই পোস্টার সাঁটানো যাবে। তবে প্রার্থীরা নির্বাচনী ক্যাম্পে পোস্টার টাঙাতে পারবেন।
>> প্রচারণায় কোনো জনসভা করা যাবে না। প্রত্যেক প্রার্থী ৫টি শোভাযাত্রা বের করতে পারবেন। এর আগে পুলিশ ও রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে স্থান।
>> নির্বাচনের দিন নির্বাচনী এলাকায় কোনো সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হবে না।
>> যান চলাচল স্বাভাবিক থাকবে; তবে মোটর সাইকেল চলাচল বন্ধ থাকবে।
সভা শেষে ইসির জনসংযোগ পরিচালক ইসরাইল হোসেন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, উভয় পক্ষের প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
রিটার্নিং কর্মকর্তা সাহতাব বলেন, “সবার সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার পর নির্ধারিত স্থানগুলো আমরা প্রার্থীদের কাছে জানিয়ে দেব। দুর্ভোগ কমাতে ও পরিবেশ রক্ষায় এসব উদ্যোগের পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি বা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে বিদ্যমান পদ্ধতিতেই প্রার্থীরা প্রচারণা চালাতে পারবেন।”
সাঁটানোর সিদ্ধান্তটা বেআইনি: ছহুল
পোস্টার সাঁটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি তুলেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন, যাদের সময় পোস্টার সাঁটানোর পরিবর্তে রশিতে ঝোলানোর রীতি চালু হয়েছিল।
ছহুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবার সঙ্গে আলোচনা করে আচরণবিধিটা করা হয়েছে। বিদ্যমান আচরণবিধি প্রতিপালন করাটাই মুখ্য। এখন নতুন করে কিছু করতে হলে বিধিটা পরিবর্তন করতে হবে। তা না করে সমঝোতা করাটা সমীচীন হবে না।
“বিশেষ করে পোস্টার সাঁটানো বা লাগানোর কোনো সুযোগ নেই। সবখানে টানিয়ে রাখতে হবে। সাঁটানোর ব্যবস্থা করতে দেওয়াটা হবে বেআইনি। বিদ্যমান বিধিতে কোনোভাবেই পোস্টার সাঁটিয়ে দেওয়ার বিধান নেই।”
২০০৭-২০১২ মেয়াদে নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ছহুল, ওই কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন এ টি এম শামসুল হুদা।
বিদ্যমান আচরণবিধির যথাযথ প্রয়োগ করার বিষয়ে তৎপরতা থাকলেই জনদুর্ভোগ অনেকাংশে কমে যাবে বলে মনে করেন ছহুল।
সফলতার আশায় সিইসি
সভায় জানানো হয় ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে মাইকিং, পোস্টার, সড়ক বা ফুটপাতের উপর ক্যাম্প স্থাপনের কারণে জনদুর্ভোগ হয়। এছাড়া লেমিনেটেড পোস্টার ব্যবহারের উপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সামনের নির্বাচনগুলোতে এসব যন্ত্রনা দূর করতে নির্বাচন কমিশন এ উদ্যোগ নিয়েছে।
বিদ্যমান আচরণবিধির পরও এবারই প্রথম প্রার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রচার-প্রচারণায় কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হল।
সভার শুরুতে প্রার্থীদের উদ্দেশে সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেন, “ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ২৫ টন পোস্টার এমনভাবে ঝোলানো হয়েছিল যে আকাশের চাঁদ-সূর্য দেখা যায়নি। এসব পোস্টার ড্রেনসহ বিভিন্ন স্থানে গেছে। এতে পরিবেশ নষ্ট হয়। এছাড়া মাইকিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ক্ষতি হয়েছে।”
এ উপনির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে এ সমঝোতা সফল হলে জাতীয় নির্বাচনের আচরণ বিধিমালা সংশোধন করা হবে বলে জানান সিইসি।
প্রার্থীরা যা বললেন
এই উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, “নির্ধারিত স্থানে পোস্টার লাগানো, শোভাযাত্রা করা কিংবা লেমিনেটেড পোস্টার না লাগানোসহ বেশ কিছু বিষয়ে আমরা ঐক্যমত হয়েছি।
“এখন এটা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে কোনো দ্বিমত থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয়। আমরা জনদুর্ভোগ কমাতে ও পরিবেশের ক্ষতি না করার বিষয়ে এখনই একমত হতে পেরেছি।”
ভোটের দিন নগরী যেন কোনোভাবেই যান চলাচলহীন না থাকে, সে বিষয়ে ইসিকে বলেছেন বলে জানান তিনি।
বিএনপির প্রার্থী শেখ রবিউল আলম বলেন, “এখানে সমঝোতা সইয়ের বিষয় নয়; আমরা দূষণমুক্ত প্রচারের বিষয়ে কয়েকটি জায়গায় এক হতে পেরেছি। কমিশন খসড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্তগুলো এখনও আমার কাছে দেয়নি।
“২১টি জায়গায় ৬ প্রার্থীর জন্যে স্ট্যান্ড করে দেবে; সেখানেই আমরা পোস্টার লাগাবো। শোভাযাত্রাও করতে পারব ৫টি। এখন সমভাবে সব কিছু করার আশ্বাসে আমরা এক হয়েছি।”
জনদুর্ভোগ কমানোর বিষয়ে যে কোনো উদ্যোগে কারও আপত্তি নেই বলে মন্তব্য করেন এই বিরোধী প্রার্থী।
“নির্বাচনী আইনে কিছু অধিকার আমাদের আছে; এখন সবাই যদি কোনো বিষয়ে একমত হয়, তাতে আমারও আপত্তি নেই। আমরা চাই সবার জন্য সমান সুযোগ হোক।”
আরও যত দাবি
নৌকার প্রার্থী মহিউদ্দিন বলেন, বিলবোর্ডে প্রচারের সুযোগ দিতে হবে। ভোটের আগে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) দেখার সুযোগ দেওয়া উচিৎ।
ইভিএম নিয়ে বরাবরই আপত্তি করে আসছে বিএনপি।
ধানের শীষের প্রার্থী রবিউল বলেন, “এজেন্টদের নিরাপত্তা দেওয়া হয় না। তাদেরকে বের করে দেওয়া হয়। এজেন্টদের কেন্দ্রে যাওয়া, অবস্থান ও বাড়িতে ফেরার নিরাপত্তা দিতে হবে।”
লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী শাহজাহান বলেন, “নির্দিষ্ট স্থানে প্রচার চালালে অলিগলিতে তা সম্ভব হবে না। এতে ভোটাররা প্রার্থী সম্পর্কে জানতে পারবেন না। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হবে। কীভাবে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো যায়, তা ভেবে দেখা উচিৎ।”
এজেন্টরা যাতে নিরাপদে কেন্দ্রে অবস্থান করতে পারে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ইসির কার্যকর ভূমিকা চেয়েছেন তিনি।
ইসি বলেছে, এজেন্টদের কেন্দ্রে নেওয়ার দায়িত্ব ইসির না। এটা রাজনৈতিক দলের, প্রার্থীর। তবে কেন্দ্রে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব প্রিজাইডিং কর্মকর্তার। কেউ নিরাপত্তা না দিলে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।