ভেনেজুয়েলার স্কুলগুলোতে ক্ষুধার্ত শিক্ষার্থীরা জ্ঞান হারাচ্ছে
ছয় বছরের অর্থনৈতিক সংকট, পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ভেনেজুয়েলার স্কুলগুলো থেকে এখন প্রতিনিয়তই ক্ষুধার্ত শিক্ষার্থীদের জ্ঞান হারানোর খবর মিলছে।
শিক্ষকের ঘাটতি, মিড ডে মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই লাতিন আমেরিকার এ দেশটির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
ধারাবাহিক অর্থনৈতিক সংকট ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণে দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যত ধসে পড়ছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
মার্কিন এ সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদন শুরুই হয়েছে সমুদ্র তীরবর্তী বোকা দে উশির শহরের অগাস্তো ডি’অবেতেরে লিসিয়াম স্কুলের পাঠদান শুরুর আগের প্রার্থনার সময় ঘটা ঘটনা দিয়ে।
অক্টোবরের সকালে কয়েকশ শিক্ষার্থীর এ প্রার্থনায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্থানীয় পাদ্রী জর্জ কুইন্তেরো।
১৫ মিনিটের ওই প্রার্থনার মধ্যেই স্কুলটির পাঁচ শিক্ষার্থী অচেতন হয়ে পড়ে; এদের মধ্যে দুজনকে তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাম্বুলেসে করে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সকালের নাস্তা না করে আসায়, কিংবা আগের রাতে ডিনার না করায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের এ অচেতন হয়ে পড়ার ঘটনা প্রতিনিয়তই শোনা যাচ্ছে।
অনেক শিক্ষার্থী আবার তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খাবার মিলবে কিনা এমনটা জেনে তারপর স্কুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
“কঙ্কালসার এবং ক্ষুধার্তদের আপনি শেখাতে পারবেন না,” বলেছেন শিক্ষক ও বোকা দে উশিরের ইউনিয়ন নেতা মাইরা মারিন।
ছয় বছরের অর্থনৈতিক সংকট এভাবেই দেশটির শিক্ষা কাঠামোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে, যে শিক্ষা কাঠামোই দশককাল আগেও লাতিনের এ দেশটির অন্যতম গর্ব ছিল; অতীতে দেশটির দূর্গম এলাকাগুলো থেকেও এমন সব মেধাবী শিক্ষার্থী বের হতো, যারা ভেনেজুয়েলার বিশ্ববিদ্যালয়তো বটেই এমনকি মার্কিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও জায়গা করে নিতো।
কেবল ক্ষুধাই সমস্যা নয়; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাখ লাখ মানুষ ভেনেজুয়েলা ছেড়ে অন্যান্য দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন, যাদের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও আছে। কম বেতন, মুদ্রাস্ফীতির কারণে অনেক শিক্ষক চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন।
এসব কারণে যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা কলকাকলিতে মুখর থাকতো, এখন সেখানে দেখা মিলবে হাতে গোণা কয়েকশ ছাত্র-ছাত্রীর।
“পুরো একটি প্রজন্ম পিছিয়ে পড়ছে,” বলেছেন কারাকাসের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষা বিষয়ক গবেষক লুইস ব্রাভো।
লাতিনের এ দেশটির সরকার ২০১৪ সাল থেকে শিক্ষা বিষয়ক পরিসংখ্যান প্রকাশ বন্ধ রেখেছে। কিন্তু পাঁচটি প্রদেশের ডজনের বেশি স্কুল ঘুরে, সেখানকার শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে নিউ ইয়র্ক টাইমস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উপস্থিতির হার কমার চিত্র দেখার কথা জানিয়েছে।
এ পরিস্থিতি ভেনেজুয়েলার স্বঘোষিত ‘সোশালিস্ট সরকারের’ জন্যও বিব্রতকর, দীর্ঘদিন ধরেই যারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য ও চিকিৎসায় সবার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ভেনেজুয়েলা সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে দুইটি দেশকে ‘রোল মডেল’ মনে করছে, সেই রাশিয়া ও কিউবার চিত্রের সঙ্গেও এটি একেবারেই মানানসই নয়।
২০১৩ সালে নিকোলাস মাদুরো দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর হার কমা শুরু হয়; প্রধান রপ্তানি পণ্য তেলের দাম কমতে থাকার পাশাপাশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির বিপরীতে মাদুরোর বিভিন্ন পদক্ষেপ দেশটির অর্থনীতিকে এমন মন্দার মুখে ঠেলে দিয়েছিল, যা থেকে এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তারা।
অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেক স্কুল শিক্ষার্থীদের খাবার দেয়ার নিয়ম বাতিল করে দিয়েছে; অনেক অভিভাবকের পক্ষেও আর ইউনিফর্ম, স্কুল খরচ ও বাস ভাড়া দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বন্ধের পর চলতি বছর সেপ্টেম্বরে স্কুল খোলার পর দেশটির সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষকের মধ্যে কয়েক হাজার শিক্ষকই কাজে যোগ দেননি বলে দেশটির ন্যাশনাল টিচারস ইউনিয়ন জানিয়েছে।
ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষকই আর মাসিক আট ডলারের সমপরিমাণ অর্থে কাজ করতে চাইছেন না; এর বদলে তারা হয় বিদেশে ভাগ্য অন্বেষণে যেতে কিংবা ভেনেজুয়েলার অবৈধ স্বর্ণখনিতে কাজ করতে বেশি আগ্রহী বলে ধারণা জুলিয়া রাজ্যের শিক্ষক ইউনিয়নের প্রধান আলেক্সান্ডার ক্যাস্ট্রোর।
অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত কম যে শিক্ষকরা সব শ্রেণির শিক্ষককে এক কক্ষে বসিয়েই পাঠ দিচ্ছেন; নিউ ইয়র্ক টাইমস যেসব স্কুল ঘুরে দেখেছে তার প্রায় সবগুলোই সপ্তাহে এক বা দুদিনের বেশি খোলা থাকে না বলে জানিয়েছে।
অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়ে বাবা-মাকে ক্ষেতের কাজ বা মাছ ধরায় সহযোগিতা করছে বলেও জানিয়েছে তারা।
মাদুরোর পূর্বসূরী উগো চাভেজের সময়ে এর বিপরীত চিত্র ছিল; চাভেজ তার ’২১ শতকের সমাজতন্ত্র’ অর্জনের লক্ষ্যে অসংখ্য স্কুল খুলেছিলেন, ছিল মিড ডে মিল, বৃত্তি।
এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হার তার তুলনায় অনেক নেমে এলেও মাদুরো বলছেন, শত্রুদের ‘বর্বর অর্থনৈতিক যুদ্ধ সত্ত্বেও’ তার সরকার শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে নজর সরায়নি।
“ভেনেজুয়েলায় কোনো স্কুল বন্ধ হয়নি, কখনো হবে না, একটি শ্রেণিকক্ষও বন্ধ হবে না,” এপ্রিলে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে এমনটাই বলেছিলেন তিনি।
শিক্ষক সংকট মেটাতে অগাস্টে তিনি তার দলের অনেক নেতাকর্মীকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বেচ্ছাশ্রমেও পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছেন।
যদিও তাতেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি।
স্কুলের ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে বোকা দে উশিরের কারুতো পরিবার তাদের স্কুলগামী নয় শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে।
“ক্ষুধার্ত অবস্থায় আমি তাদের স্কুলে পাঠাতে পারি না,” বলেছেন দুই শিশুর বাবা লুইস কারুতো।
৩৬ বছর বয়সী কারুতো এখন বেকার। বাস ভাড়া দিতে না পারায় তার বোন উক্সি কারুতোর লেখাপড়াও বন্ধ। ১৭ বছর বয়সী এখন সময় কাটাচ্ছে নিজের এক বছর বয়সী সন্তানের সেবাযত্নে।
“আমি গণিত শিখতে চেয়েছিলাম, দ্রুত পড়তে ও লিখতে চেয়েছিলাম। আমি ভয় পাচ্ছি, যখন আমার সন্তান বড় হবে আর আমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে, আমি তার জবাব কীভাবে দিতে হয় জানবো না। অবশ্য এখন, আমাদের খাবার মতোই পর্যাপ্ত অর্থ নেই,” ভাষ্য উক্সির।