ভুটানের সঙ্গে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর সমঝোতার পাঁচটি দলিলে সই করেছে বাংলাদেশ ও ভুটান; যার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক সম্পর্কে জড়িত দক্ষিণ এশিয়ার এ দুটি দেশের বন্ধন আরও গভীর হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে।
গতকাল শনিবার সকালে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংয়ের নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর স্বাস্থ্য, কৃষি, নৌ পরিবহন, পর্যটন খাতে সহযোগিতা এবং জনপ্রশাসন খাতে প্রশিক্ষণের বিষয়ে এসব সমঝোতা স্মারক ও এসওপি সই হয়। বৈঠকের বিস্তারিত সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
শহীদুল হক বলেন, ভুটানের সঙ্গে আমাদের খুবই গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক। ভুটান প্রথম রাষ্ট্র যারা আমাদের স্বীকৃতি দেয়। তাই ভুটানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গাঢ়। পরবর্তী বছরগুলোতে সম্পর্কের আরও উন্নতি হয়েছে। ক্রমশই এ সম্পর্ক গভীর ও স¤প্রসারিত হচ্ছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের পর বাণিজ্য বেড়েছে এবং মানুষে মানুষেও সম্পর্ক বাড়ছে।
সফররত লোটে শেরিং সকাল ১০টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছলে তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান শেখ হাসিনা। এরপর দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠকের পর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এরপর দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এসব সমঝোতা ও এসওপি সই হয়।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটানের সম্পর্কই যে গভীর হচ্ছে তা নয়; ব্যবসা ও পযটনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যাপ্তিটাও বাড়ছে।
ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশ ভুটানের কাছে ১০টি পণ্যে কোটা ও শুল্কমূক্ত সুবিধা চেয়েছে আর ভুটান বাংলাদেশের কাছে চেয়েছে ১৬টি পণ্যে।
ভুটান ডব্লিউটিওর সদস্য না হওয়ায় তাদের নিজস্ব কিছু আইন ও বিধিমালা আছে। তাই কোটামূক্ত, শুল্কমূক্ত সুবিধার প্রশ্ন উঠছে। এটা নিয়ে পজিটিভ আলোচনা হয়েছে। আমরা ধরে নিতে পারি যে এটা নীতিগত সম্মতি হয়েছে।
বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপালকে নিয়ে আঞ্চলিক কানেকটিভি (বিবিআইএন) গড়ে তোলার উদোগ নেওয়া হলেও ভুটান এখনো ওই চুক্তিতে অনুসাক্ষর না করায় তা আটকে আছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ট্রানজিটের ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের উদ্যোগ এ অঞ্চলে আছে। বিবিআইএন-এ সব রাষ্ট্র সই করেছে। কিন্তু এটা অনুসাক্ষরের বিষয়ে ভুটান তাদের পার্লামেন্টে পাঠাতে পারেনি। এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ভুটানের নতুন সরকার বলছে, তারা এই বিষয়টি আলোচনার জন্য আপার সিনেটে নিয়ে আসবে। তারা খুবই আশাবাদী। আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান শহীদুল হক।
তিনি বলেন, ভুটানে জলবিদ্যুৎ তৈরি, উৎপাদন এবং এ অঞ্চলে বাজারকরণের ব্যাপারে একটা আলোচনা আমাদের বেশ কিছুদিন ধরে আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ এখানে বিনিয়োগও করতে যাচ্ছে। এই আলোচনা বেশ অ্যাডভান্সড স্টেজে আছে। আমরা আশা করি এটা দ্রুত সাক্ষর করবে। এটা একটা ত্রি-পাক্ষিত সহযোহিতা হবে। ভুটানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে সেটা ভারত ও বাংলাদেশে বাজারজাতকরণ হবে।
চিকিৎসাখাতেও দুদেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সার্ক স্কলারশিপে মেডিকেল ও নার্সিংয়ে বাংলাদেশে ভুটানিদের জন্য বরাদ্দ ১০টা সিট বাড়িয়ে ১৫টি করা হয়েছে।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের প্রশংসা করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে তারা ফিজিশিয়ান নেবেন।
শহীদুল হক বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার কথা জানান ভুটানের প্রধানমন্ত্রী। সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের অটিজম নিয়ে সচেতনতার বিষয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে উনার বিরাট কন্ট্রিবিউশন রযেছে।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও কার্গো পরিবহনের সমঝোতা স্মারককে কাযকর করার লক্ষ্যে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) সই হয়। এতে বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন নৌ পরিবহন সচিব মো. আবদুস সামাদ এবং ভুটানের পক্ষে সই করেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য বিভাগের পরিচালক সোনম তেনজিন। স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম এবং ভুটানের স্বাস্থ্য সচিব ডা. উজেন দফু সই করেন।
বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্স কাউন্সিলের (বিএআরসি) এবং ভুটানের কৃষি ও বন মন্ত্রণালয় পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এতে সই করেন বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. কবির ইকরামুল হক এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভুটানের রাষ্ট্রদূত সোনম তোবদেন রাবগি।
জনপ্রশাসনে পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে সই করেন বাংলাদেশ জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ সেন্টারের রেকটর এম আসলাম আলম এবং বাংলাদেশে ভুটানের রাষ্ট্রদূত।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এবং ভুটানের পর্যটন কাউন্সিলের মধ্যে সমঝোতা স্মারকে সই করেন বাংলাদেশ পযটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান আখতারুজ জামানখান কবির এবং বাংলাদেশে ভুটানের রাষ্ট্রদূত।
চার দিনের সফরে শুক্রবার ঢাকায় পৌঁছান লোটে শেরিং। গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটিই বিদেশি কোনো সরকার প্রধানের প্রথম বাংলাদেশ সফর। শুক্রবার ঢাকায় এসেই বঙ্গবন্ধু প্রতিকৃতি ও জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান ভুটানের প্রধানমন্ত্রী। বিকালে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক মতবিনিময় করেন তিনি।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্র ডা. শেরিংয়ের হৃদয়ে একটি বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে বাংলাদেশ। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অষ্টাদশ ব্যাচের ছাত্রলোটে শেরিং এমবিবিএস পাস করার পর বাংলাদেশেই সার্জারিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। দেশে ফিরে যোগ দেন চিকিৎসকের পেশায়।
সরকারি চাকরি ছেড়ে ২০১৩ সালে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই তার দল ডিএনটি চমক সৃষ্টি করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ডিএনটি জয়ী হলে ডা. শেরিং হন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী।
রোববার পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর। ভোরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সুরের ধারার আয়োজনে পহেলা বৈশাখেরঅনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকবেন। পরে যাবেন নিজের পুরনো শিক্ষায়তন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। সেখানে বর্তমান শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হবেন তিনি। বিমসটেকের সদস্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এ জোটের সচিবালয়েও যাবেন লোটে শেরিং। সফর শেষ করে ১৫ এপ্রিল তার ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।