ভার্চুয়াল আদালতে কাজ শুরু
এক ধরনের পরিকল্পনা আগেই ছিল, তবে করোনাভাইরাস সঙ্কট দিয়েছে গতি, আর তাতেই বাংলাদেশে ভার্চুয়াল আদালত কার্যক্রমে গড়াল
উচ্চ আদালতে সোমবার সকাল থেকে আইনজীবীদের নিবন্ধন ও আবেদন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভিডিও কনফারেন্সসহ অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে আদালত পরিচালনার ‘প্র্যাকটিস’ নির্দেশনা মেনে উচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে আবেদন করেন আইনজীবীরা।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, “সোমবার সকাল থেকে সারা দেশে ভার্চুয়াল কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উচ্চ আদালতেও বিজ্ঞ আইনজীবীরা আবেদন ফাইল করেছেন।
“একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে অনিবার্য কারণেই দেশে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু হল। বলা যায়, আজকের দিনটি দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি বিশেষ দিন। আশা করছি, এই প্রক্রিয়াটিতে বিচার বিভাগের কার্যক্রম সফলভাবেই সম্পন্ন হবে।”
কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আদালতের বিচারকাজ চালানোর অধ্যাদেশ জারির পর ‘প্র্যাকটিস ডাইরেকশন’ জারি করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তার ভিত্তিতে শুরু হল নতুন ধরনের আদালত কার্যক্রম।
মহামারীর কারণে সাধারণ ছুটি ও অবকাশের মধ্যে এই আদালত পরিচালনার জন্য হাই কোর্টে তিনটি বেঞ্চ পুনর্গঠন করে দেন প্রধান বিচারপতি। এছাড়া আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত পরিচালনার জন্য মনোনয়ন দেন বিচারপতি নুরুজ্জামানকে।
রোববার সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর, রেজিস্ট্রার মো. বদরুল আলম ভূঞা ও হাই কোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান ভূঁইয়া এ সংক্রান্ত আলাদা তিনটি বিজ্ঞপ্তি দেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বিচারকদের বিচারিক এখতিয়ার উল্লেখ করে বলা হয়, জরুরি সকল প্রকার রিট ও দেওয়ানি মোশন এবং এ সংশ্লিষ্ট আবেদনপত্র গ্রহণ করবেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
জরুরি সব ধরনের ফৌজদারি মোশন ও এ সংক্রান্ত জামিনের আবেদন গ্রহণ করবেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন।
আর বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার আদীম অধিক্ষেত্রাধীন জরুরি বিষয়; যেমন,সম্পত্তি, বিয়ে,কোম্পানিসহ বিভিন্ন বিষয়ের আপিল ও আবেদন গ্রহণ ও শুনানি করবেন।
তিন ক্ষেত্রেই আইনজীবীরা তিনটি আলাদা ইমেইল ঠিকানায় আবেদন করছেন।
এদিকে চেম্বার আদালতের দিনক্ষণ উল্লেখ করে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চেম্বার বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান আগামী ১৪ ও ২০ মে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শুনানি নেবেন।
কিছু সমস্যা দেখছেন আইনজীবীরা
ভার্চুয়াল আদালতে আবেদন জানিয়ে কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন আইনজীবীরা।
সোমবার সকালে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে তিনটি জামিন আবেদন জমা পড়ে।
আইনজীবী দেওয়ান মো.আবু ওবায়েদ হোসেন, আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ও আইনজীবী মো.শাহীন মিয়া এ তিনটি আবেদন করেন। তিনটিই জামিন সংক্রান্ত আবেদন।
রাষ্ট্রেপক্ষে এ আদালতে দায়িত্বে আছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. বশিরুল্লাহ। তার সঙ্গে আছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।
বশিরুল্লাহ বলেন, সকাল ১১টা থেকে আবেদনের কার্যক্রম শুরু হয়।
সর্বমোট ১৬টি জামিন আবেদন জমা পড়ে প্রথম দিনে। এ আবেদনগুলো বেঞ্চ কর্মকর্তা স্বচ্ছতা যাচাই করে বিচারপতির কাছে পাঠাবেন। বিচারপতি দেখবেন আবেদনটি জরুরি কি না?
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশিরুল্লাহ বলেন, “যদি জরুরি মনে করেন তাহলে মঙ্গলবার আমাদের কাছে আবেদনের অনুলিপি পাঠাবেন। মাননীয় বিচারপতি আবেদনগুলো শুনানির জন্য গ্রহণ করলে মঙ্গলবার কার্যতালিকায় আসবে এবং পরশু শুনানি হতে পারে। ওইদিন থেকে আদালতের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হবে বলা যায়।”
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ভার্চুয়াল আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে দায়িত্বে আছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার ও সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস।
এই আদালতে একটি রিট আবেদন জমা পড়েছে। চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ডলফিন শিকার বা হত্যা বন্ধ চেয়ে আবেদনটি করা হয়েছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বলেন, “আমরা আসলে জানতে পারব উনারা (বিচারপতি) যাচাই-বাছাই করে আমাদের আমাদের কাছে পাঠানোর পর। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো আবেদনের অনুলিপি আসেনি।”
বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের ভার্চুয়াল আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে দায়িত্বে আছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল মাগমার ও অমিত দাশগুপ্ত।
অমিত বলেন, “আমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে খোঁজ নিয়েছি। কোনো আবেদন জমা পড়েনি এই আদালতে।”
আদালত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটাতে আসলে এক ধরনের অব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে।
“ক্লিয়ার পিকচার কেউ দিতে পারছে না। ইউএনডিপি বলছে, তারা একটি লিঙ্ক দেবে এবং একটি সফটওয়ার দেবে। এটা উদ্বোধনের পর তারা একটা ইমেইল ক্রিয়েট করে দেবে, সেটার মধ্যে সবাই আবেদন পাঠাবে। এখন আইনজীবীরা আবেদন কীভাবে জমা দিয়েছেন, বুঝতে পারছি না।”
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে জমা পড়া তিনটি জামিন আবেদনের মধ্যে একটি করেছেন আইনজীবী শিশির মনির।
তিনি বলেন, “জরুরি বিবেচনায় দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদ সাহেবের জামিন চেয়ে আবেদনটি করা হয়েছে। পাঁচ মাস ধরে কাস্টডিতে আছেন তিনি।”
ভার্চুয়াল আদালত নিয়ে শিশির মনির বলেন, “সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করলে বলতে হবে, কোর্ট খুলেছে, এটাই তো একটা বিরাট সুবিধা। অন্ততপক্ষে কিছুটা জরুরি বিষয় আদালতের নজরে আনা যাবে। আমি এটিকে সমর্থন জানাই। কারণ এই পদ্ধতি থাকলে দুর্নীতিটাও কম হবে।”
দুটি সমস্যা তুলে ধরে শিশির মনির বলেন, “আমি যখন আবেদন করলাম, আমি কিন্তু আবেদনটাকে ট্রেক করতে পারছি না। আমাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে উনারা সেটার রিপ্লাই দেওয়ার পর। এখানে এই সিস্টেমটার উন্নতি দরকার আছে বলে মনে করি।
“আরেকটি বিষয়ও আছে। সেটি হলো আমাদের ওকালতনামা সংগ্রহ করতে হয় জেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। এই পরিস্থিতিতে জেল থেকে ওকালতনামার হার্ডকপি আমি কেমনে পাব? আমাকে তো যেতে হবে। অথবা আসামির আত্মীয়-স্বজনদের যেতে হবে। তাইলে তো আর ভার্চুয়াল থাকল না।
“জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে ওকালতনামারও যদি একটি ভার্চ্যুয়াল সিস্টেম করা যেত অর্থাৎ আবেদন করলে জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের ইমেইলে ওকালতনামা পাঠিয়ে দিতেন, তাহলে আর কোনো অসুবিধা হত না। এই দুটি জায়গায় উন্নতি করার আছে বলে আমি মনে করি।”
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিন বলেন, এই সঙ্কটকালে ভার্চুয়াল আদালত চালু হওয়া ‘অসম্ভব ভালো’ একটি পদক্ষেপ।
“এই মুহুর্তে এর চেয়ে ভালো পদক্ষেপ আর কিছু হতে পারে না। মানুষের আইনগত অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হল।”
অনভ্যস্ততার কারণে শুরুতে কিছু সমস্যা হলেও পরে তা কেটে যাবে বলে আশাবাদী আইনজীবীদের এই নেতা।
“বিচারকরা এই প্রক্রিয়াটির সাথে অভ্যস্ত না থাকার কারণে, আইনজীবীরা অভ্যস্ত না থাকার কারণে, কোর্টের স্টাফরা অভ্যস্ত না থাকার কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা হয়ত কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হব। তবে আমি বিশ্বাস করি যে আমরা যদি প্রশিক্ষণ নিই, সবাইকে যদি এই প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করতে পারি, তাহলে এর সুফল আমরা পাব।”
ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার জন্য একটি ওয়েব পোর্টাল ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। এই আদালত ব্যবহারে ‘আমার আদালত : ভার্চুয়াল কোর্টরুম ব্যবহার ম্যানুয়াল’ ও দেওয়া হয়েছে।
আবেদন, শুনানি সবই হবে ওই পোর্টালে। ইমেইলে শুনানির সময় ও ভিডিও কনফারেন্সের লিংক পাঠানো হবে আইনজীবীকে। এসএমএসে দেওয়া হবে অ্যালার্ট। নির্দিষ্ট সময়ে বিচারক ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবী যুক্ত হবে ভিডিও কনফারেন্সে।
শুরুতে এ পদ্ধতিতে শুধু জামিন আবেদন দাখিল, শুনানি ও বেইল বন্ড দাখিলের সুযোগ পাবেন আইনজীবীরা।
এজন্য mycourt.judiciary.org.bd ওয়েবসাইটে ঢুকে একজন আইনজীবীকে মোবাইল নম্বর, নিজের পূর্ণ নাম, ছবি, ইমেইল দিয়ে নিবন্ধন করতে হচ্ছে।