ভারতে নাটকের দিন ফেরাচ্ছে ওটিটি
পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী রাসিকা দুগাল তার অভিনয় জীবনে এত বেশি কাজ আগে কখনও পাননি, এতটা পরিচিতও হয়ে ওঠেননি।
ভারতের এই অভিনয়শিল্পী এখন তারকা খ্যাতির দিকে এগোচ্ছেন – নেটফ্লিক্সে ‘দিল্লি ক্রাইমে’র দ্বিতীয় মৌসুমে এবং সিনেমা ‘লর্ড কার্জন কি হাভেলি’-তে শিগগিরই আসছেন তিনি। আরেকটি টিভি সিরিজেও তিনি অভিনয় করছেন।
ভারতে নাটকের অভিনয়শিল্পীদের জন্য কিছু কাল আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। কীভাবে তা বদলে গেল স্ট্রিমিং সার্ভিসের প্রভাবে, তা দেখার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
আরও অনেক অভিনয় শিল্পীর মতোই ক্যারিয়ারের শুরুর বছরগুলো রাসিকা জন্য ছিল বেশ কঠিন, হতাশাজনকও।
তিনি এমন সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন, যা মুক্তি পায়নি কিংবা বক্স অফিসে জায়গা পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি, দর্শকরাও তার কাজ দেখতে পারেননি।
রাসিকা বিসিসিকে বলেন, “শিল্পী হিসেবে ওই ধরনের সিনেমাগুলোতে কাজ করার অভিজ্ঞতা তৃপ্তিদায়ক হলেও সেগুলো দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। অথচ আমার বিশ্বাস, সেগুলোর আরও ভালো দর্শক প্রাপ্য ছিল।”
চলচ্চিত্রের পরিবেশনা বা প্রদর্শনের বিষয়টি যখন সামনে আসে, রাসিকার অভিনীত ছোট বাজেটের সিনেমাগুলোর বিপণন বরাদ্দ থাকে না। বড় ব্লকবাস্টার সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে দর্শক পেতে তাদের কঠিন সময় পার করতে হয়।
রাসিকা বলেন, “জনপ্রিয় ও সহজগম্য সব সিনেমা হল ও শো-এর সময় এরইমধ্যে বড় সিনেমাগুলো কিনে রেখেছে।”তবে তার জন্য সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে ২০১৮ সালে। ওই বছর স্ট্রিমিং সার্ভিস অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে ক্রাইম থ্রিলার ‘মির্জাপুর’ প্রচারিত হয়। ওই ধারাবাহিকে ‘বীণা ত্রিপাঠী’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পুরস্কার জেতেন রাসিকা, এরপরই তার কাছে কাজের বন্যা বইতে শুরু করে।
রাসিকা বলেন, “স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম চলে আসায় আমার ক্যারিয়ার বদলে গেছে। শুধু কাজের সংখ্যার কারণে নয়, কাজের মান এবং বৈচিত্র্যের কারণেও।”
বিবিসি বলছে, এখন বিশ্বজুড়েই অভিনয় শিল্পীদের জন্য গল্পটি অনেকটা এই রকম। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, অ্যাপল ও অন্যান্য স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরমগুলো মৌলিক নাটকের জন্য অর্থ লগ্নি করছে।
অ্যামপেরে অ্যানালাইসের হিসাবে, গত বছর স্ট্রিমিং ইন্ডাস্ট্রি তাদের কনটেন্ট নির্মাণের জন্য ২২ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি।
ভারতে ২০১৯ ও ২০২০ সালে মৌলিক ও নিবন্ধিত ভারতীয় কনটেন্ট নির্মাণের জন্য নেটফ্লিক্স একাই ৪০ কোটি ৫০ লাখ ডলার খরচ করেছে।
অর্থের এই বিপুল প্রবাহের মানে হচ্ছে ভারতে বর্তমানে ৩০টিরও বেশি স্ট্রিমিং সেবা বা ওভার-দ্য-টপ বা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে।
বৈচিত্র্যের এই দেশে কয়েকশ ভাষা রয়েছে, আঞ্চলিকতার প্রভাবও আছে। এই বিপুল বিনিয়োগের মানে হচ্ছে মাতৃভাষার আরও দর্শক তৈরি করার সম্ভাবনা।
নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার কনটেন্ট শাখার ভাইস-প্রেসিডেন্ট মনিকা শেরগিল বলেন, “গত বছর নেটফ্লিক্সের ২৮টি ভারতীয় মৌলিক নির্মাণ সাতটি ভাষায়, আটটি ফরম্যাটে ও ১১টি জনরায় (শাখা) প্রস্তুত করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে সিনেমা, ধারাবাহিক, কমেডি, রিয়ালিটি শো ও তথ্যচিত্র।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আরও বেশি সংখ্যায় বৈচিত্র্যপূর্ণ সিনেমা যুক্ত করার সুযোগ থাকায়, আমরা দেখছি আরও বেশি [মানুষ] সেগুলো খুঁজে নিচ্ছে এবং আগ্রহ নিয়ে ওইসব সিনেমা দেখছে। ভারতে গল্প বলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং বিনোদন নিয়ে বিপুল ভালোবাসা রয়েছে; এখানে আমরা এখনও আমাদের অভিযাত্রার শুরুর ধাপে আছি।”
আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং-এর গণমাধ্যম ও বিনোদন বিশ্লেষক আশিস ফেরওয়ানির হিসাবে ,ভারতের ৩০ কোটি পরিবারের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি পরিবার নেটফ্লিক্সের মতো বিভিন্ন স্ট্রিমিং সেবার দর্শক।
এই সংখ্যা বাড়ার বিস্তর সুযোগ রয়েছে। আশিস ফেরওয়ানির ধারণা, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই পারিবারিক দর্শকের বাজার ৬ কোটিতে পৌঁছাবে এবং মোট দর্শক সংখ্যা পৌঁছাতে পারে ২০ কোটিতে।
তিনি বলেন, “আমরা দেখবো বড় প্ল্যাটফরমগুলো এবং নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দর্শকের জন্য কনটেন্ট আসবে এবং সেখানে বিভিন্ন প্যাকেজিং, বান্ডেল ও দামের মডেলও থাকবে।”
ভারতের অন্যতম বড় সিনেমা প্রযোজনা কোম্পানি রায় কাপুর ফিল্মসের প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধার্থ রায় কাপুর স্বীকার করেছেন যে স্ট্রিমিং সেবা ভারতের বিনোদন জগতের জন্য ‘স্বর্ণ যুগ’ সৃষ্টি করেছে। তবে কিছু বিষয়ে সতর্কও তিনি।
একজন প্রযোজক হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে প্রচলিত ধারায় একটি সিনেমা নির্মাণের পর মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে এখনও অনেক বেশি আয় করা যায়,যেহেতু প্রযোজক সংস্থার হাতেই থাকে সিনেমার স্বত্ব।
সিদ্ধার্থ র বলেন, কিন্তু স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের জন্য কনটেন্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে সবসময় বিষয়টি এমন থাকে না, তারা একবারই নির্মাতাকে অর্থ দেয় এবং ওই আধেয়র স্বত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নে“যদি সিনেমা হলে চলচ্চিত্র মুক্তি দেওয়া হয়, প্রযোজক তার বিনিয়োগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ফেরত পান; যদি সিনেমাটি ভালো হয় এবং আপনি কনটেন্টের মালিক হন।”
তিনি আরও মনে করেন, স্ট্রিমিং ব্যবসা খুব দ্রুতগতিতে বিস্তৃত হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত হয়ত কিছু প্ল্যাটফর্মেকে অন্য প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে মিলে যেতে হবে।
অবশ্য ভারতীয় অভিনয় শিল্পীরা এই জোয়ারকে ভালোই উপভোগ করছেন।
এমনই একজন অভিনয় শিল্পী সাকিব সালিম, যিনি সম্প্রতি একাধিক সিনেমা ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অভিনয় করেছেন।
তার ভাষ্যে, এখন যে ধরনের কাজের প্রস্তাব তারা পাচ্ছেন সেগুলোর মান ও বৈচিত্র্য আগে কখনই এত ভালো ছিলো না।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “এটা (স্ট্রিমিং) দর্শকদের কাছে, তাদের সংস্কৃতি ও ভৌগলিক অবস্থানের দূরত্ব ঘুচিয়ে বিনোদন জগতকে আরও প্রবেশযোগ্য করে তুলেছে বলে আমি মনে করি। ফর্মুলা ধারাবাহিক বা সিনেমা নয়, কনটেন্ট নির্মাতারা তাদের গল্পে মনোযোগ দিচ্ছেন, যা খুবই চমকপ্রদ।”