ভারতের নাগরিকত্ব আইনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না: শ্রিংলা
নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দিল্লিতে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় বাংলাদেশে উদ্বেগের মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা আবারও বলেছেন, নাগরিকপঞ্জি হালনাগাদের বিষয়টি একান্তই ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’।
সোমবার ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে এক সেমিনারে শ্রিংলার এ মন্তব্য আসে, যিনি গতবছরও বাংলাদেশে ভারতের হাই কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন।
ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশন ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিস) আয়োজিত এই সেমিনারের শিরোনাম ছিল- ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া: এ প্রমিজিং ফিউচার’।
শ্রিংলা বলেন, “নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে এবং অনেকগুলো অভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারা থাকায় এটা অস্বীকার করা যায় না যে, আমাদের দুই দেশেরই কিছু ঘটনা কারণে বা অকারণে সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো আসামে নাগরিকপঞ্জি হালনাগাদকরণ, যে প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছে।”
ভারত সরকার সম্প্রতি নাগরিকত্ব আইন (সিএএন) সংশোধন করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের হিন্দুসহ কয়েকটি ধর্মাবলম্বীদের তাদের দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এই সংশোধনের কারণ ব্যাখ্যা করে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, হিন্দুসহ এসব ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্যরা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বিভিন্ন সময়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
তার আগে আসামে নাগরিকপঞ্জি প্রণয়ন করা হয়, যাতে ভারতের বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যটিতে নাগরিকের তালিকা থেকে বাদ পড়েন বহু মানুষ। আসামের অনেকের অভিযোগ, বাংলাদেশ থেকে গিয়ে অনেকে ওই রাজ্যে আবাস গড়েছেন।
গত সপ্তাহে দিল্লিতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) সমর্থক ও বিরোধীদের পাল্টাপাল্টি মিছিল থেকে সংঘর্ষ শুরু হলে এক পর্যায়ে তা দাঙ্গার রূপ নেয়। টানা কয়েক দিনের সংঘাতে অন্তত ৪৬ জন নিহত, যাদের অধিকাংশই আইন সংশোধনের বিরোধিতাকারী মুসলমান।
দিল্লির ওই ঘটনা বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িক অশান্তির শঙ্কা তৈরি করে। ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার যেভাবে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে, তা নিয়ে সমালোচনা হয়।
সোনারগাঁও হোটেলে সোমবার ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া: এ প্রমিজিং ফিউচার’ সেমিনারে অংশ নেওয়া অতিথিরা। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা বলেন, “এখানে আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বারবার বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আশ্বস্ত করেছেন যে, এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণের ওপর এর কোনো প্রভাব থাকবে না। আমরা এই ব্যাপারে আপনাদের আশ্বস্ত করছি।”বক্তব্য শেষে এক প্রশ্নের জবাবে শ্রিংলা বলেন, “প্রথমত, নাগরিকত্ব বিল কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। দ্বিতীয়ত, নির্যাতনের শিকার হয়ে এসে যারা ভারতে আছেন, তাদেরকে দ্রুততার সঙ্গে নাগরিকত্ব দেওয়া এর উদ্দেশ্য। এবং তৃতীয়ত, এটি (বাংলাদেশের) বর্তমান সরকারের সময়ের জন্য কার্যকর হবে না। কার্যকর হবে ১৯৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসক ও অন্য সরকারগুলোর সময়ে, যারা এখানে সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার দেয়নি।”
‘মানবিক বিবেচনা’ থেকেই ভারত সরকার নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেছে দাবি করে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “বর্তমানে হাজার হাজার মানুষ আছে, যারা ঘরবাড়ি ও রাষ্ট্রহীন। তারা নাগরিত্ব পাবে। আগে যেখানে ১০ বছর লাগত, সেখানে এখন লাগবে ৫ বছর।”
পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা পাঁচ হাজার মানুষকে গত পাঁচ বছরে ভারত নাগরিকত্ব দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতের আইন অনুযায়ী স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই এটা করা হচ্ছে।
আসামের নাগরিকপঞ্জিও বাংলাদেশে এখন কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মন্তব্য করে শ্রিংলা বরেন, “যারা বাদ পড়েছেন তারা ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবেন। পরে যেতে পারবেন ভারতের হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে। এই দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার কারণে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এটার প্রভাব নিয়ে বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। যেহেতু এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু, তাতে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।”
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গরোহিঙ্গা সঙ্কটে ভারত সরকারের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সেমিনারে বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানবিক সঙ্কট বাংলাদেশের ওপর যে প্রভাব ফেলছে এবং এ বিষয়ে ভারতের যে অবস্থান তা নিয়ে অনেকের আগ্রহ আছে, অনেকের আবার কিছু ‘ভিত্তিহীন ধারণাও’ রয়েছে।
“আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ভারত বাংলাদেশের মানবিক বোধের গভীর প্রশংসা করে, আপনারা প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন। আপনারা যে বোঝা বহন করছেন আমরা তা স্বীকার করি ও সমবেদনা জানাই।”
একমাত্র ভারতই যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার- উভয়ের প্রতিবেশী, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “আমরা এমন একটি সমাধান চাই, যা সবপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো যাতে দ্রুততম সময়ে রাখাইনে ফিরতে পারে, সম্মানজনক জীবন ফিরে পেতে পারে, সেজন্য সহযোগিতা করতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।”
শ্রিংলা বলেন, এই প্রত্যাবাসন হতে হবে ‘নিরাপদ ও টেকসই’।
বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য ভারত সরকারের তরফ থেকে ত্রাণসামগ্রীর পাঁচটি চালান পাঠানোর কথা অনুষ্ঠানে মনে করিয়ে দেন পররাষ্ট্র সচিব। পাশাপাশি রাখাইনে বসতঘর নির্মাণসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা করার কথাও তিনি তুলে ধরেন।
“এই বিশাল মানবিক সংকট মোকাবেলায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ বিষয়ে আমাদের পরামর্শ হল, বৃথা বাগাড়ম্বর না করে এ সমস্যার একটি মানবিক ও বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজে বের করতে হবে, যা সবপক্ষের জন্যই সম্মানজনক হবে।”
বিআইআইএসএস চেয়ারম্যান ফজলুল করিমের সভাপতিত্বে এ সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী।
অন্যদের মধ্যে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশ ও বিআইআইএসএস-এর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক কর্নেল মাসুদ আহমেদ আলোচনায় অংশ নেন।