ভাঙা হচ্ছে স্বর্ণকমল
অবশেষে ভেঙে ফেলা হচ্ছে খুলনার এরশাদ শিকদারের রহস্যময় বাসভবন সেই ‘স্বর্ণকমল’। স্ত্রী-সন্তানদের সিদ্ধান্তে মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) থেকে ভাঙা হচ্ছে ভবনটি। এটি খুলনা মহানগরীর মজিদ সরণীতে অবস্থিত। ফাঁসির রশিতে ঝুলে মৃত্যুদণ্ড হওয়া ভয়ঙ্কর খুনি এরশাদ শিকদারকে জড়িয়ে স্বর্ণকমলে রয়েছে নানা ঘটনা-রটনা।
শোনা যাচ্ছে- অর্থের প্রয়োজনে বড় স্ত্রী খোদেজা বেগম ও তার সন্তানরা আলোচিত স্বর্ণকমলসহ ৫ কাঠা জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। যেখানে বহুতল বিশিষ্ট ভবন তৈরি করা হবে।
আলোচিত ও দর্শনীয় ভবনটি ভাঙার খবর ছড়িয়ে পড়লে কৌতুহলী মানুষ ভবনের সামনে ভিড় করে। ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসি কার্যকরের মধ্যে দিয়ে এরশাদ শিকদার অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তাঁর প্রিয় ‘স্বর্ণকমল’ ঘিরে তৈরি হয় নানা রহস্য। প্রায় দুই দশক পরও দূর-দুরান্ত সেখানে সেখানে ছুটে আসতো মানুষ। এটি ছিল এরশাদ শিকদারের বাসভবন। এই ভবণ নির্মাণ, স্থাপত্যশৈলী, ভবন অভ্যন্তরে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়েও ছিল আলোচনা। এবার হয়তো সেই অধ্যায়ের যবনিকা ঘটবে। ভাঙা পড়ছে রহস্য ঘেরা স্বর্ণকমল।
বিলাসবহুল বাড়ি ‘স্বর্ণকমল’ এরশাদ শিকদারের বহু অপকর্মের সাক্ষী। বাড়িটিতে গোপন কুঠরি এবং অস্ত্র ভান্ডারের কথাও শোনা যায়। শোনা যায়, ওই বাড়ির বিভিন্ন গোপন স্থানে নগদ কয়েক কোটি টাকা লুকানো ছিল। প্রায়ই জলসা বসতো বাড়িতে। শহরের নামিদামি ব্যক্তিরা যেতেন সেখানে। এক সময় সাধারণ মানুষের খুব আগ্রহের জায়গা ছিল ‘স্বর্ণকমল’। আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ওই বাড়িটি। বিশেষ করে ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর করার পর জৌলুশ হারানো বাড়িটি ছিল রহস্যে ঘেরা।
কথিত আছে, বাড়িটি বানানোর সময় এরশাদ শিকদারের হাতে খুন হন নির্মাতা। বাড়ি নির্মাণের গোপন বিষয়গুলো যাতে কেউ জানতে না পারে এ জন্য তাঁকে হত্যা করা হয়। আবারও কেউ কেউ বলে থাকেন, এ বাড়িটি নির্মাণের সময় কিছু অংশ অন্যের জমিতে ঢুকে যাওয়ায় নির্মাতাকে খুন করে এরশাদ শিকদার। এরশাদ শিকদার যখন জীবিত ছিলেন, তখন অবৈধ উপায়ে হাজার হাজার কোটি টাকা অর্জন করেছিলেন। বাড়িটিতে বসতো জলসা। এখানে সমবেত হতেন অনেক রথি-মহারথিরা।
বাড়ির সামনে নামফলকটি খুলে ফেলা হয়েছিল অনেক আগে। ১৮ বছর আগের সেই জৌলুশ না থাকলেও এখন মানুষ ভবনটি দেখতে আসতো। কিন্তু সম্প্রতি ভবনের একাংশ ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় এরশাদ শিকদারের ছেলেরা। সেই সিদ্ধান্তের পর বাড়ির ভিতরে ভাঙার কাজ শুরু হয়।
কর্মরত শ্রমিক আজিজুল, রহমানসহ অন্যরা জানান, স্বর্ণ কমলের অর্ধেক ভেঙে ফেলা হচ্ছে। জমির মালিকরা সেখানে বহুতল ভবন করবেন। এ কারণে গত কয়েক দিন ধরে ভাঙার কাজ চলছে।
এরশাদ শিকদারের মেজ ছেলে কামাল শিকদার জানান, কেডিএ’র ১০ কাঠা জমির ওপর তাদের পুরাতন তিন তলা এবং আরেকটি দুই তলা বাড়ি ছিল। তারা কয়েকদিন আগে পুরাতন তিন তলা ভবনটি শ্রমিক দিয়ে ভেঙে ফেলেছেন। এখন দুই তলা ভবনটির অর্ধেকের মতো অংশ ভাঙা হচ্ছে। ভেঙে ফেলা ৫ কাঠা জমির ওপর ১০ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
এরশাদ শিকদার ও অভিযোগ: এরশাদ শিকদারের কর্মকাণ্ড প্রকাশ হতে থাকলে তিনি সিরিয়াল কিলারের হিসেবে পরিচিতি পান। ৬০টিরও বেশি খুনের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। প্রতিটি হত্যার পর দুধ দিয়ে গোসল করতেন তিনি ও তার সহযোগীরা। অসংখ্য নারী ধর্ষণ, একাধিক বিয়েসহ এমন অপকর্ম নেই, যা এরশাদ শিকদার তার জীবদ্দশায় করেননি।
তিনি সদম্ভে বলতেন, পৃথিবীর কেউ তাকে তার আসন থেকে সরাতে পারবে না। তাঁর কণ্ঠে ‘আমি তো মরেই যাবো, চলে যাবো, রেখে যাবো সবি/ আছসনি কেউ সঙ্গের সাথী, সঙ্গেনী কেউ যাবি/ আমি মরে যাবো’- গানটি সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার বাবার নাম বন্দে আলী শিকদার। ৮ ভাই বোনের মধ্যে এরশাদ শিকদার ছিল দ্বিতীয়। ১৯৬৭ সালে জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় চলে আসে এরশাদ শিকদার। কিছু দিন পর রেলস্টেশনের কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করতো- এমন দলে যোগ দেয়।
পরে তাদের নিয়ে দল গঠন করে এবং এলাকায় ‘রাঙ্গা চোরা’ নামে পরিচিতি পায় শিকদার। মাত্র ১০ বছরের মধ্যে ১৯৭৬ সালে এরশাদ শিকদার রামদা বাহিনী নামে দল গঠন করে। যারা খুলনা রেলস্টেশন ও ৪ নম্বর ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এই রামদা বাহিনী নিয়ে এরশাদ শিকদার ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখল করে এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৮২ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর এরশাদ শিকদার বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু সমালোচনার মুখে কিছুদিন পরই আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন।
১৯৯৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার সময় এরশাদ শিকদার ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর আরও ক্ষমতাসীন হয়ে ওঠেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত খুলনার রেলওয়ের সম্পত্তি এবং জোরপূর্বক ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। ৬০টিরও বেশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন এরশাদ শিকদার। ২৪টি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন তার বডিগার্ড নুর আলম। ২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনার জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এরশাদ শিকদার নিয়ন্ত্রিত ঘাট এলাকাগুলোতে এখন আর তার কোনো কিছুর চিহ্ন নেই। নিজ নামে প্রাইমারি স্কুলটি রয়েছে। বরফকলের মালিকানা বদলেছে। দখলকৃত অনেক জায়গা উদ্ধার করেছে রেলওয়ে। বেশ কিছু জায়গা চলে গেছে নতুন প্রভাবশালীদের দখলে। জীবিত থাকতে তার এলাকায় তিনি ছিলেন ত্রাস। এখন তিনি চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন খুলনার টুটপাড়া কবরস্থানে।
কোথায় আছেন পরিবারের সদস্যরা: এরশাদের দুই স্ত্রী খোদেজা বেগম ও সানজিদা নাহার শোভা। এরশাদ শিকদারের তিন ছেলে রয়েছে। তারা হলেন- মনিরুজ্জামান শিকদার জামাল, কামাল শিকদার ও হেলাল শিকদার। তারা পেশায় ব্যবসায়ী। এছাড়া সুবর্না ইয়াসমিন স্বাদ ও জান্নাতুল নওরিন এশা নামে এরশাদ শিকদারের দুই মেয়ে ছিল। যার মধ্যে এশা ২০২২ সালের ৩ মার্চ আত্মহত্যা করেন।
ছেলে কামাল শিকদার যা বলেন: সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের কথা হয় এরশাদ শিকদারের মেজ ছেলে মো. কামাল শিকদারের সঙ্গে।
‘নিজের বাবাকে একজন আদর্শ বাবা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক বাবাই তার সন্তানের কাছে আদর্শ। বাবার পরিচয়েই আমরা চলছি। কোথাও বাবার পরিচয় লুকাতে হয় না। আমার বাবা ব্যক্তিগত জীবনে কী করেছেন- সেটি তার পার্সোনাল ব্যাপার। আমার বাবা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবার পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল কিন্তু তিনি আইনের প্রতি শদ্ধাশীল হয়ে স্যারেন্ডার করেছিলেন। আশা করেছিলেন, আইনের সুযোগ পাবেন। পাননি। রাজনীতিই বাবাকে ওপরে উঠিয়েছে, রাজনীতিই তাকে শেষ করেছে’ বলেও দাবি করেন শিকদার পুত্র কামাল।