বেড়েছে রডের দাম: ক্যাবের দাবি সিন্ডিকেটের কারসাজি
এক সপ্তাহের ব্যবধানে রডের টনপ্রতি বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) কোম্পানির মানভেদে (৬০ গ্রেডের ওপরে) খুচরায় প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৯১ থেকে ৯৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। যা গত সপ্তাহে টনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কম ছিল।
রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, চার কারণে রডের দাম বেড়েছে। প্রথমত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে, দ্বিতীয়ত ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়েছে, তৃতীয়ত গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে উৎপাদন কমে বেড়েছে শ্রমিক খরচ, চতুর্থত জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ায় স্ক্র্যাপের (রড তৈরির কাঁচামাল) দাম বেড়েছে।
তবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কর্মকর্তারা বলছেন, সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে দফায় দফায় বাড়ছে রডের দাম। গত চার মাসে তিনবার রডের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। অথচ বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম কমেছে।
এ বিষয়ে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম’র সিনিয়র জিএম (বিক্রয় ও বিপণন) মো. জসিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নানা কারণে রডের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো ডলার সংকট। এ কারণে ব্যাংকে এলসি খোলা যাচ্ছে না। তিন-চার মাস আগে ব্যাংকে যেসব এলসি খোলা হয়েছিল, তখন ডলারের দাম ছিল ৮৬ থেকে ৮৭ টাকা। ওই এলসির অনুকূলে এখন ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করতে হচ্ছে ১১০ টাকা হারে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতি ডলারে ২৫ টাকা করে বাড়তি গুনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। তার ওপর তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দ্বিগুণ হয়েছে জাহাজ ভাড়া, বেড়েছে পরিবহন খরচ। উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। পাশাপাশি শিপ ব্রেকার্সগুলোতে রডের কাঁচামাল সংকট রয়েছে। কমেছে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি। ইয়ার্ডে প্রতি টন স্ক্র্যাপ কিনতে হচ্ছে ৬৫ হাজার টাকায়। জাহাজের প্লেট কিনতে হচ্ছে ৮০ হাজার টাকায়। এসব কারণে বেড়েছে রডের দাম।’
বিএসআরএম’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেন গুপ্ত বলেন, ‘ডলার, জ্বালানি তেল এবং স্ক্র্যাপের দাম বাড়ায় রডের দাম বেড়েছে। আমদানি খরচ ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়াতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে উৎপাদন কমে গেছে। শ্রমিক খরচ বেড়েছে। ফলে রডের বাজারে প্রভাব পড়েছে।’
রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, ‘কাঁচামাল আমদানি থেকে উৎপাদন পর্যন্ত হিসাব করলে রডের দাম এখন অনেক বেশি পড়ছে। অথচ সবকিছু চিন্তা করে রডের দাম সেভাবে বাড়ানো হয়নি। বরং লোকসান দিয়ে রড বিক্রি করছি আমরা।’
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে ৮৮ টাকায় ডলার কিনতাম এখন ১১২ টাকায় কিনি। মাঝখানে ১৫-২০ টাকা পার্থক্য হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রতি টন স্ক্র্যাপ কিনতে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ৯ হাজার টাকা বেশি যাচ্ছে। সেইসঙ্গে লাইটার জাহাজ ভাড়া, পরিবহন ভাড়া ও শ্রমিকের বেতন বেড়েছে। রড তৈরিতে ব্যবহৃত অন্যান্য উপকরণের দামও বেড়েছে সমানতালে। তার ওপর সরকারি নির্দেশনা মেনে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সপ্তাহে একদিন মিল বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মিল বন্ধ থাকলেও শ্রমিকের বেতন দিতে হচ্ছে। এখানে কারসাজির সুযোগ নেই। খরচ বেড়েছে, এজন্য রডের দাম বেড়েছে।’
নগরীর ষোলশহরের পাইকারি রড বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আলমার্স ট্রেডিংয়ের মালিক ইমাম হোসেন বলেন, ‘সোমবার বিএসআরএম স্টিলসের রড মিলগেটে প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৯৩ হাজার টাকা, কেএসআরএম রডের টন বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার টাকা, বায়েজিদ স্টিলের রডের টন বিক্রি হচ্ছে ৮৯ হাজার টাকা এবং অন্যান্য কোম্পানির রডের টন প্রায় এক থেকে দুই হাজার টাকা কম-বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা মিলগেট থেকে নিজ খরচে পরিবহন করে নিয়ে যান। সেক্ষেত্রে প্রতি টনের দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করেন তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘রডের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বিক্রি কমেছে। আগে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ টন রড বিক্রি হতো। বর্তমানে ২০ থেকে ৩০ টন রড বিক্রি হয়। দিন দিন দাম যত বাড়ছে রড বিক্রি তত কমছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সামাজিক সংক্রমণ হয়ে উঠেছে। কার আগে কে দাম বাড়াবে এ ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। রডের দাম অস্বাভাবিকহারে বাড়ানো অযৌক্তিক। প্রথমে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও কাঁচামাল সংকট বলে রডের দাম বাড়ানো হলো। এরপর জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে রডের দাম আরেক দফায় বাড়ানো হলো। এখন জ্বালানি তেল ও ডলার সংকটের কথা বলে আরেক দফায় বাড়ানো হলো। জ্বালানি তেলের সঙ্গে রডের কি সম্পর্ক আছে, তা বুঝতে পারলাম না। দায়িত্বশীলদের নজরদারির অভাবে নিজেদের ইচ্ছে মতো রডের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে নির্মাণকাজে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।’
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে স্বয়ংক্রিয় ইস্পাত কারখানা আছে ৩০টি। সনাতন পদ্ধতির কারখানা আছে ১০০টির মতো। বছরে দেশে রডের চাহিদা আছে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টন। এ হিসাবে মাসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টন রড দরকার হয়। রড তৈরির কাঁচামাল হলো পুরনো লোহার টুকরো। এই কাঁচামাল সরাসরি আমদানি করে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করেন উৎপাদকরা। বাকি প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ আসে জাহাজভাঙা শিল্প এবং লোকাল ভাঙারি বর্জ্য থেকে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, ‘বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম টনপ্রতি ৫২০ থেকে ৫৫০ ডলার। দুই মাস আগে স্ক্র্যাপের দাম ৪৫০ থেকে ৫০০ ডলারে ছিল। এর আগে অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরপরই আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম ছিল ৭২০ থেকে ৭৫০ ডলার। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম কমলেও ডলারের দাম বেশি হওয়ায় কাজে আসছে না।’
তিনি বলেন, ‘বেশি টাকার এলসি খোলা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পর বন্ধ হয়ে যায় স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি। তাদের কাছে যা ছিল তা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। ৫০ হাজার টাকা টনের স্ক্র্যাপ কিনতে হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ হাজার টাকায়। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় মালামাল পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে উৎপাদন কমে গেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় শ্রমিক খরচ বেড়েছে। ৮৪-৮৫ টাকার ডলার এখন ১১০ টাকায় ঠেকেছে। এখানে ব্যবসায়ীদের কোনও কারসাজি নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। আমাদের ব্যবসা প্রতিযোগিতামূলক। এখানে বেশি লাভ করার সুযোগ নেই।’
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআর) সহকারী সচিব নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রামে একসময় ১৫৪টি শিপ ব্রেকার্স ছিল। বর্তমানে ৩০টির মতো শিপ ব্রেকার্স সচল আছে। এর মধ্যে অধিকাংশে জাহাজ নেই। স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি গত কয়েক মাসে অনেক কমে গেছে। আগে যেখানে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করা হতো, সেখানে গত দুই মাসে আমদানি হয়েছে ১৪-১৫টি জাহাজ। অর্থাৎ দুই মাসে ৫০-৬০টি জাহাজের স্থলে আমদানি হয়েছে মাত্র ১৪-১৫। এজন্য স্ক্র্যাপের দাম বেড়েছে।’
বিএসবিআর’র সহ-সভাপতি কামাল উদ্দিন বলেন, ‘শিপ ব্রেকার্সগুলোতে এখন প্রতি টন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার টাকায়। স্ক্র্যাপ লোহার এত বেশি দাম আগে কখনও হয়নি। এবারই সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে। বেশি টাকার এলসি খোলা নিয়ে ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণে এমনটি হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্কুলারে বেশি টাকার এলসি খোলা নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এজন্য স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে। আগের আনা ১০-১১টি জাহাজ আছে শিপ ব্রেকার্সগুলোতে। এলসি খোলা বন্ধ থাকলে সামনে স্ক্র্যাপ সংকট আরও বাড়বে। তখন রডের দামও আরও বাড়বে।