বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে প্রাধান্য রাজনৈতিক বিবেচনা!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী রোবেল আহম্মেদ। ছাত্রজীবনে ছিলেন মাস্টার দা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৮৩, অনার্সে ৩.৬৯, এইচএসসির জিপিএ-৫ এবং এসএসসিতে ৪.৪৪। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। তার কোনো গবেষণাকর্ম নেই।
তার আগে-পরে একই বিভাগ থেকে পাস করে বেরিয়েছেন কয়েকজন। এদের একজন মো. ওমর ফারুক। তিনি অনার্স, মাস্টার্স ও এমফিল করেছেন। মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৯০, অনার্সে ৩.৮৩, এইচএসসিতে জিপিএ-৫, এসএসসিতে ৪.৮৩। দুটি গবেষণাও আছে তার।
মো. ওয়ালিউর রহমান আকন্দ নামে আরেকজনের গবেষণা ও প্রকাশনা চারটি। তিনি এখন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক পদে আছেন। মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৭৮, অনার্সে সিজিপিএ ৩.৬০, এইচএসসিতে জিপিএ ৪.৭০, এসএসসিতে ৪।
আবু হানিফ নামে একজনের মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৯৮, অনার্সে ৩.৮৩, এইচএসসিতে জিপিএ ৪.৩৩, এসএসসিতে ৪.৫৮।
জিএম রাকিবুল ইসলাম যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন। পাশাপাশি তার ৯টি গবেষণা, দুটি বই ও ৭টি প্রবন্ধ আছে।
তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের প্রার্থী।
এছাড়া মোহাম্মদ রাসেল উদ্দিন নামে একজন প্রার্থীর পিএইচডি ও এমএসসি ডিগ্রি আছে। তার গবেষণা ১০টি। এইচএসসি ও এসএসসির শিক্ষাগত যোগ্যতা বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ করে না বলে বাদ দেওয়া হয়েছে তাকে। অথচ সেটি উচ্চতর ডিগ্রির ক্ষেত্রে শিথিল করার কথা ছিল।
কিন্তু বিষয় হলো উপরের প্রার্থীদের মধ্যে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ফলাফল কিংবা গবেষণার দিক দিয়ে সব মিলিয়ে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে থাকা রোবেল আহম্মেদ।
অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাংকিং নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। শিক্ষা ও গবেষণায় সর্বাধিক গুরুত্বের কথা বললেও যোজন যোজন পিছিয়ে। নিয়োগের ক্ষেত্রেও ‘ব্যক্তিপছন্দ’ ও ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’ও নতুন নয়। সবশেষ এর প্রতিফলন দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে।
নিয়োগবঞ্চিতদের অভিযোগ, বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সব যোগ্যতা থাকার পাশাপাশি গবেষণা থাকার পরও তাদের বিবেচনা করা হয়নি। বরং তুলনামূলক রেজাল্টে পিছিয়ে ও পুরো শিক্ষাজীবনে থিসিস বা গবেষণা নেই এমন একজনকে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান, যিনি ছাত্রলীগের পদধারী ছিলেন। শুধু তাই নয়, দুজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। অথচ পাঁচ-ছয়জন যোগ্যপ্রার্থী থাকলেও নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা একজনকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আবেদনকারী জাগো নিউজকে বলেন, আমি ভালো রেজাল্ট করে দেখলাম, এর কোনো মূল্য নেই। আমাদের চার-পাঁচজনের ভালো রেজাল্ট, অভিজ্ঞতা ও গবেষণা থাকা সত্ত্বেও আমাদের বাদ দিয়ে ছয় নম্বর পজিশন থেকে স্যাররা নিতে চাইছেন। এখানে আমাদের কী করার আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে যদি স্টিয়ারিং কমিটি থাকতো বা পলিসি থাকতো, তাহলে এটা হতো না। তাকে তাদের পছন্দ হয়েছে। এখানে আর কোনো যুক্তি নেই।
তিনি আরও বলেন, সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থী এক সময় রাজনীতি করতেন, স্যারদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য এভাবেই লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এটা সবাই জানে।
বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এন্ট্রি পয়েন্টে (প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পদে) নিয়োগে ফলাফলকে গুরুত্ব দেই। উচ্চতর পর্যায়ে গবেষণার গুরুত্ব বেশি। সারা পৃথিবীতে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগে ফলাফলের চেয়ে মুখ্য হলো- তিনি ডিগ্রি কোথা থেকে করছেন, তার প্রকাশনা, তার গবেষণা, তার গবেষণা অরগানাইজ করার সক্ষমতা এবং ফান্ডিং সক্ষমতা। ব্রিটেনে এখন পরিচালক হতে বা প্রফেসর হতে হলে প্রজেক্ট আনতে হয়। না হয় জীবনেও প্রফেসর হতে পারবে না। আজীবন প্রভাষক থাকতে হবে। এটা কলেজের শিক্ষক নয় যে, দেখবে চাকরির বয়স কত আর রেজাল্ট কী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মোটামুটি সেই স্ট্যান্ডার্ডটা মানে।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে কাজ শিক্ষা ও গবেষণা। শুধু শিক্ষাদান আমাদের কাজ নয়। এখানে গবেষণার গুরুত্ব অধিক। তবে এন্ট্রি লেভেলে ফলাফলটাই মুখ্য।
আইইআরের বিজ্ঞপ্তিতে কিন্তু বলা ছিল- উচ্চতর ডিগ্রি প্রাধান্য দেওয়া হবে। যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তাদেরই যদি গবেষণা না থাকে তাহলে কীভাবে আমরা গবেষণায় নজর দেবো, এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, এই কথাটা যৌক্তিক নয়। এটা খোঁড়া যুক্তি এবং অসৎ উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো বলা হয়। কারণ যে পদের জন্য যে যোগ্যতা সেটার মৌলিক বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয় অধিকাংশ সময়।
শিক্ষক নিয়োগে গবেষণায় প্রাধান্য দেওয়া হয় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্তর ভেদে। কোথাও কোথাও আছে ফ্রেশ, সেটা আরও বেশি পটেনশিয়াল। এটার অনেক ক্রাইটেরিয়া আছে। বেস্ট ইয়াং মাইন্ড যখন হয়, তখন সে আরও ভালোমানের গবেষণা করার সক্ষমতাও রাখে। এখন তো গবেষণা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনছি, যাতে গুণগত মানসমৃদ্ধ গবেষণা করতে পারে। মূল বিষয়টা দেখতে হবে- ন্যূনতম রিকোয়ারমেন্টের ক্ষেত্রে যেন কম্প্রোমাইজ না করা হয়। একটা ভালো জিনিসের ওপর ভালো কিছু বিল্ডআপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, এমন অভিযোগ উঠেছে। আসলে রাজনৈতিক সংগঠনের পদে ছিলেন কি না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সুপারিশপ্রাপ্ত রোবেল আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমি কী ছিলাম, না ছিলাম, ওটা কি মুখ্য বিষয়? শিক্ষক হওয়ার জন্য রাজনৈতিক পদ মুখ্য বিষয় নয়। আমি এখন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। যোগ্যতা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইটেরিয়া মেনটেইন করে পরীক্ষা দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ বোর্ড আমাকে সুপারিশ করতে পারে, নাও করতে পারে। সুপারিশ করেছে কি না, সে বিষয়টি আমি জানিও না। আপনাদের কাছ থেকেই শুনি।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্ট্যারন্যাশনাল, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগে মেধার চেয়ে অন্য বিষয়গুলো বিবেচিত হয়। যদিও ঢালাওভাবে সবাই এটা করে তা নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুইভাবে নিয়োগ বা পদোন্নতি হয়- যোগসাজশে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে, আরেকটা হলো রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, এভাবে শিক্ষক নিয়োগ হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন, সেটি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এতে শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শিক্ষার্থীরাও প্রত্যাশিত শিক্ষা পাচ্ছে না। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় মানের দিক থেকে বা র্যাকিংয়ে পিছিয়ে থাকছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি অশনিসংকেত।
‘এখান থেকে বেরিয়ে আসতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। নিয়োগের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে’- যোগ করেন ইফতেখারুজ্জামান।