বিশ্বজুড়ে চিপ সংকটের অশনিসংকেত
নতুন গাড়ি কিনতে চান? স্মার্টফোন কিংবা ওয়াশিং মেশিন? বিশ্বজুড়ে কম্পিউটার চিপ সংকটের কারণে সেটি হাতে পেতে কিছুটা দেরি হতে পারে, লাগতে পারে বাড়তি টাকাও।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রস্তুতকারকরা ক্রমবর্ধমানভাবে সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এতে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে বা পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
এই পরস্থিতির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ দায়ী। প্রথমটি অবশ্যই করোনাভাইরাস মহামারি। এর কারণে গত বছর ভয়াবহ বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, ভেঙে পড়েছিল সরবরাহ ব্যবস্থা। এতে বদলে গেছে ভোক্তাদের কেনাকাটার পদ্ধতিও।
মহামারিতে চাহিদা কমে যাওয়ায় গত বছর গাড়িনির্মাতারা চিপের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছিলেন। ঠিক সেই সুযোগটাই কাজে লাগান অন্য যেসব পণ্যের চাহিদা বেড়েছে তাদের নির্মাতারা। তারা যতটা সম্ভব চিপের মজুত বাড়িয়ে নেন। এছাড়া চীনা প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, প্রাকৃতিক দুর্যোগও চিপ সংকট তৈরিতে বড় অবদান রেখেছে।
কম্পিউটার চিপ শুধু দামী গাড়িতেই ব্যবহৃত হয় না, ছোটখাটো অন্য ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জামগুলোতেও এর দরকার পড়ে। অথচ চিপের এই সংকট ক্রমেই আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, এই পরিস্থিতি চলতি বছরের পুরোটা সময়জুড়ে থাকতে পারে।
গোল্ডম্যান স্যাশ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ১৬৯টি প্রতিষ্ঠান সেমিকন্ডাক্টরের অভাবে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় এই সংকট ২০২২ সাল পর্যন্ত চলতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে ব্যাংকটি।
গাড়ি শিল্পে বিপর্যয়
সাধারণ একেকটি গাড়িতে গড়ে ৫০ থেকে ১৫০টি চিপ দরকার হয়। নেভিগেশন কন্ট্রোল, ড্রাইভার অ্যাসিসট্যান্স সিস্টেমের মতো ক্ষেত্রগুলোতে এর ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে।
গত বছর করোনা মহামারির কারণে গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। সেসময় তাদের চিপগুলো চলে যায় স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ও গেমিং ডিভাইস কোম্পানিগুলোর হাতে।
তবে গাড়িশিল্প ধারণার চেয়েও দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসে। নির্মাতারা উৎপাদনের গতি বাড়িয়ে দেন। কিন্তু আটকে যান চিপ জোগাড় করতে গিয়ে।
ভক্সওয়াজেন, ফোর্ড, ফিয়াট ক্রাইসলার, নিসানের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো চিপ সংকটে গত জানুয়ারিতে উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে। সেই সংকট এখনো চলছে।
গত বৃহস্পতিবার বিএমডব্লিউর মালিকানাধীন মিনি জানিয়েছে, সেমিকন্ডাক্টরের অভাবে তাদের ইংল্যান্ডের একটি কারখানা তিনদিন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
ফোর্ড বলেছে, চিপ সংকটের কারণে চলতি বছর অন্তত ১১ লাখ গাড়ি কম উৎপাদন হবে এবং এতে আয় কমে যেতে পারে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার।
স্মার্টফোন এবং অন্য সরঞ্জাম
চিপ সংকটের কালোছায়া নেমেছে ইলেক্ট্রনিক পণ্য নির্মাতাদের ওপরও।
স্যামসাং গত বৃহস্পতিবার জনিয়েছে, তারা সেমিকন্ডাক্টর এবং অন্য যন্ত্রাংশের সংকট কমাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। তবে এই পরিস্থিতিতে স্মার্টফোনের মতো পণ্যগুলোর উৎপাদন কমে যেতে পারে।
অ্যাপলের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা লুকা মায়েস্ত্রি বলেছেন, চিপ সংকটের কারণে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে তাদের মুনাফা তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে আইপ্যাড ও ম্যাকের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মূল্যবৃদ্ধি
চিপ সংকটের প্রভাব শুধু উৎপাদকদের ওপরই নয়, নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ভোক্তা পর্যায়েও। এই সংকটে পণ্যের খুচরা মূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে গোল্ডম্যান স্যাশের বিশ্লেষক বলেন, যদিও ইলেকট্রনিক পণ্য এবং গাড়ির চাহিদা বেশ দাম সংবেদনশীল মনে হয়, এমনকি মূল্যবৃদ্ধির মধ্যেও তা সহনীয় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আমাদের ধারণা, সরবরাহ কমার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর দাম এক থেকে তিন শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে চলতি বছরের শেষের দিকে সাময়িক মুদ্রাস্ফীতিও তৈরি হতে পারে।