বিদ্যানন্দ প্রতিষ্ঠাতা কিশোর আপাতত চেয়ারম্যান পদেই থাকছেন
করোনাভাইরাস সঙ্কটের এই সময়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাসের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সহকর্মীরা।
তিনি কোভিড-১৯ ক্যাম্পেইন শেষ না হওয়া অবধি চেয়ারম্যান পদে বহাল থাকছেন বলে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা বিভাগের সমন্বয়ক সালমান খান ইয়াসিন জানিয়েছেন।
তিনি মঙ্গলবার বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উগ্রবাদী কিছু সংগঠন আর ফেইসবুক ইউজার কারও কারও নেগেটিভ কমেন্টে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন আমাদের চেয়ারম্যান। তাছাড়া কাজের এত চাপও তিনি সামলাতে পারছিলেন না। তিনি বলেছিলেন, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে থেকে কাজ করবেন।
“তারপর তিনি হঠাৎ চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেও আমরা তার রিজাইন লেটার অ্যাকসেপ্ট করি নাই। কোভিড-১৯ ক্যাম্পেইন শেষ হলে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আপাতত তিনি চেয়ারম্যানের পদে বহাল থাকছেন।”
সালমান আরও বলেন, “কিশোর কুমার দাস প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে গেলে যোগ্য কাউকে না পেলে পদটি শূন্য থাকবে।”
দেশের এই সঙ্কটকালে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য ত্রাণ নিয়ে পুরো শহরময় ছুটছে এর স্বেচ্ছাসেবীরা৷ সশস্ত্র বাহিনীসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায়ও ত্রাণ পাঠাচ্ছে।
যখন চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক, নার্সদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের সংকট ছিল তখন বিদ্যানন্দ নিজেদের বাসন্তী গার্মেন্টসে পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বানিয়েছে। সেই পিপিইগুলো বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
মসজিদ, হাসপাতাল, বাস, রেলস্টেশনের মতো জায়গাগুলো যেখানে জনসমাগম বেশি হয়, ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারে, সেখানে জীবাণুনাশকও ছিটিয়েছে।
মানুষের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে দিতে রাজধানীর মিরপুর, ফার্মগেট, গুলশান, শাহবাগসহ বিভিন্ন স্থানে বসিয়েছে অস্থায়ী হাত ধোয়ার বেসিন। সরবরাহ করা হয়েছে পানি ও সাবান। তৈরি করেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক; যা বিতরণ করা হয়েছে খেটে খাওয়া মানুষদেরকে৷
পুরো রমজান মাসজুড়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন বিভিন্ন এলাকায় দুস্থ পরিবারগুলোকে ইফতার ও সেহেরি দিচ্ছে।
মানবিক এমন কর্মকাণ্ডে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রশংসা যখন দেশজুড়ে, তখন কিশোর কুমার দাসের পদত্যাগের খবর নিয়ে আলোচনা সৃষ্টি হয়।
শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ ফেইসবুকে লিখেছেন, “বিদ্যানন্দ – Bidyanondo নাম থাকবে। কিশোর কুমার দাসও থাকবেন। কিশোর কুমার দাস মনে রাখবেন, যে যুদ্ধে জয়ী হতে চায়, সে একাই লড়াই করতে যায়, কারো জন্য অপেক্ষা করে না।”
কবি ও লেখক শাহীন রেজা রাসেল লিখেছেন, “প্রিয় কিশোর, আমরা সমগ্র জাতি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। দয়া করে ধর্মব্যবসায়ীদের নোংরা কথায় আপনি পদত্যাগ করবেন না। ওদের মুখে থুথু ছুঁড়ে দিন। তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে আবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। বিদ্যানন্দকে এগিয়ে নিন আরো সামনে। আমরা আছি আপনার পাশে।”
অভিনেত্রী শাহনাজ খুশী লিখেছেন, “বিদ্যানন্দমানুষের কাছে দরদী ইতিহাস হয়ে গেছে, এটা নিয়ে হিংসাত্মক কিছু করে কোন লাভ নাই! এর রদবদল করে ,একটা মায়াবী আশ্রয় নষ্ট হবে, একটা সুন্দর ইতিহাস পঁচে যাবে শুধু! যারা করছে তাদের যোগ্যতা শুধু নষ্ট করা!! জাতীয় সংগীতের উপর আংগুল তুলে যেমন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শেষ হয়ে যায় না! কিশোর দাশকে নিয়ে আংগুল তুলেও তাকে নিঃশেষ করা যাবে না। তিনি মানবতার দরদী ফেরিওয়ালা!
“পৃথিবীর যেখানে যাবে তার মনন/মেধা/ কলিজার ত্যাগের তাগত/মানবতার জয়গান,তাকে আরও উচ্চে তুলে ধরবে!! দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের! বঙ্গ মায়ের বিছানো আঁচলে এখন আর সবার ঠাঁই হয় না………….”
ত্রাণ বিতরণ শেষে পথেই সেহরি খাচ্ছেন বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীরা
এর পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সকালে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে একটি ঘোষণায় বলা হয়েছিল, “সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে নয়, বরঞ্চ ব্যক্তিগত ত্যাগে স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপ্রাণিত করার এবং নতুন মেধায় প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করার স্বপ্নে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিশোর দাস।
“আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বিষয়টি হতাশার নয়। বরঞ্চ পদ আঁকড়ে থাকার মানসিকতার এই সমাজে উল্টা পথে হাঁটতে পারার জন্য গর্ব হচ্ছে। আর বিদ্যানন্দে পদে কী যায় আসে? এখানে তো কাজটাই আসল, আর সেটাই আমরা করে ছাড়ব।”
পুরো ঘোষণায় বলা হয়, “বিদ্যানন্দ নামটি দিয়েছেন এক মুসলমান ব্র্যান্ড এক্সপার্ট। আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন-স্লোগানের সাথে মিল রেখে তিনি নামটি দিয়েছিলেন। অনেকেই এটাকে ব্যক্তির নাম থেকে ভেবে ভুল করেন। এজন্য আমরা দুই বছর আগে নাম পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটে করি এবং স্বেচ্ছাসেবকরা নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে ভোট দেয়।
“বিদ্যানন্দের প্রবাসী উদ্যোক্তা সশরীরে খুব অল্পই সময় দিতে পারেন। ৯০% মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকরাই চালিয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির বিশাল কর্মযজ্ঞ। তবুও উদ্যোক্তার ধর্ম পরিচয়ে অনেকেই অপপ্রচার চালায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে। যাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় কার্যক্রম, অনুদানের গতি।”
গত মাসেই কিশোর কুমার পদত্যাগের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন জানিয়ে এতে বলা হয়েছিল, “সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে নয়, বরঞ্চ ব্যক্তিগত ত্যাগে স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপ্রাণিত করার এবং নতুন মেধায় প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করার স্বপ্নে এমন সিদ্ধান্ত। আর তিনি প্রধানের পদ ছাড়লেও বিদ্যানন্দ ছাড়ছেন না, বরঞ্চ সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে চেয়েছেন।
“আমরা বিষয়টি প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম চলমান ক্যাম্পেইনের পরে। কিন্তু কিছুদিন ধরে চলা মাত্রাতিরিক্ত সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে জল ঢালতে খবরটি আজকে শেয়ার করলাম।”
ওই ঘোষণা দেখে ফেইসবুকে শুরু হয় সমালোচনা, তখন মঙ্গলবার বিকালে সুর পাল্টায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
এতে বলা হয়, “কোভিড-১৯ ক্যাম্পেইন ফোকাস রাখতে নির্বাহী কমিটির সদস্যরা কিশোর দাসের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি।
“কিশোর কুমার দাশ এখনও চেয়ারম্যান পদে আছেন এবং সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যতদিন বিদ্যানন্দ থাকবে তিনি আমাদের প্রতিষ্ঠাতা এবং পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন।”
কমলাপুর রেলস্টেশনে জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
‘পড়বো, খেলবো, শিখবো’ স্লোগানকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিদ্যানন্দের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রকল্প ‘এক টাকার আহার’। ২০১৬ সালে এই প্রকল্পটি শুরু হয়। এক টাকার বিনিময়ে অসহায় পথশিশুরা এই খাবার পায়। পরে তাদের কর্মকাণ্ড আরও বিস্তৃত হয়।
বর্তমানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, রাজশাহী, কক্সবাজারসহ মোট ১৩টি শাখা রয়েছে বিদ্যানন্দের। এছাড়া তাদের পাঁচটি স্কুলে একাডেমিক শিক্ষা পাচ্ছে এক হাজারেরও বেশি শিশু। তাদের ছয়টি অনাথ আশ্রমে রয়েছে ৪৫০ জনের বেশি শিশু।
সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় ২৫টির বেশি স্পটে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার শিশুর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
এক টাকায় স্যানিটারি প্যাড, এক টাকায় চিকিৎসাসহ নানা রকম কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছে শত নারী ও শিশু।