বছর ঘুরল প্রায়, উহানের সেই সি ফুড মার্কেট এখনও অবরুদ্ধ
উহানের ৩৮ বছর বয়সী রেস্তোরাঁ মালিক লাই উন যে জায়গায় থাকেন, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে হুয়ানান সি ফুড হোলসেল মার্কেটে যেতে লাগে দশ মিনিট। প্রতিদিন সকালে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর পর ওই মার্কেটে যাওয়া তার রুটিন হয়ে উঠেছিল।
এক বছর হতে চললো, লাই উন আর সেই মার্কেটে যান না। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাত থেকে জনশূন্য ওই মার্কেট অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
বিশ্বের অনেকেই এখন হুয়ানান সি ফুড হোলসেল মার্কেটকে চেনেন নতুন করোনাভাইরাসের উৎসস্থল হিসেবে, যদিও বিষয়টি এখনও প্রমাণিত নয়।
ওই বাজারে মুরগি, বাদুড়, খরগোশ, সাপ, সামুদ্রিক প্রাণীসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বিকিকিনি হত। গতবছর ডিসেম্বরের শেষে উহানে চারজনের মধ্যে নতুন ধরনের এক নিউমোনিয়া ধরা পড়ে, যাদের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ওই বাজারের যোগাযোগ ছিল।
এরপর হঠাৎ বদলে যায় সব। ওই রাতেই বন্ধ হয়ে যায় মার্কেট। পরের মাসের শেষ দিকে পুরো শহর চলে যায় ৭৬ দিনের কঠোর লকডাউনে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিসে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায় বাসিন্দাদের।
এরপর প্রায় এক বছরে বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেওয়া কোভিড-১৯ এ ১৫ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। চীন মাস তিনেকের মধ্যে অতি ছোঁয়াচে এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও পুরো বিশ্ব এখন ধুঁকছে।
চীনের উহান শহরের হুয়ানান সি ফুড মার্কেটের তৃতীয় তলায় চশমার দোকানগুলো শূন্য। ছবি: রয়টার্স
লকডাউন উঠে যাওয়ার পর গত এপ্রিলে আবার প্রাণ ফিরতে শুরু করে উহানে। কিন্তু অনেক কিছুই আর আগের অবস্থায় ফেরেনি। অবরুদ্ধ অবস্থায় এখনও খালি পড়ে রয়েছে ওই সি ফুড মার্কেট।
‘নভেল’, মানে নতুন করোনাভাইরাস নাম পাওয়া এই ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বেইজিংয়ের বাগযুদ্ধের প্রতীক হয়ে আছে এই মার্কেট।
ভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল উহান ও এই মার্কেট পরিদর্শন করবেন বলে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তা আর হয়নি।
চীন ও অন্যান্য দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, ভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানের এ কাজে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে, এবং শেষ পর্যন্ত কোনো মীমাংসায় পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে।
করোনাভাইরাসের উৎসস্থল হিসেবে উহানের নাম বলা হলেও সেখানকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ওই কথা তাদের বিশ্বাস হয় না।
স্থানীয় কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী চেন বলেন, “এটা কোনোভাবেই উহান থেকে হতে পারে না… কেউ এখানে নিয়ে এসেছে। অথবা বাইরে থেকে অন্য কোনো পণ্যের সঙ্গে এসেছে। এখানে শুধু দেখা দিয়েছে।”
সম্প্রতিক মাসগুলোতে চীনা কূটনীতিক ও রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমও বলছে, তাদের বিশ্বাস ওই মার্কেট থেকে ভাইরাসটি ছড়ায়নি, বরং রোগের ‘ভিকটিম’ হয়েছে সেটি। অন্য কোনো দেশেই এই ভাইরাসের উৎস, তা প্রমাণে নানা তত্ত্বও হাজির করা হচ্ছে।
প্রবেশে বিধি-নিষেধ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন করোনাভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানে এখনও সি ফুড মার্কেটটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটি ধ্বংস করা ঠিক হবে না। যদিও এসব গবেষণার অধিকাংশই নির্ভর করবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর সংগ্রহ করা নমুনার ওপর।
চীনের উহান শহরের হুয়ানান সি ফুড মার্কেটটি গতবছর ৩১ ডিসেম্বর রাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছবি: রয়টার্স
ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের ভাইরোলজির অধ্যাপক জিন ডং-ইয়ান বলেন, “প্রথম কেইসগুলো উহানের ওই মার্কেটের, তাই অন্তত এসব কেইসের উৎস খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে এর প্রতি আগ্রহ থাকবে। এছাড়া কিছু ধারণা, যেমন কোনো বন্যপ্রাণী থেকে ভাইরাসটি এসেছে কি না, বা কোনো ব্যক্তি সুপারস্প্রেডার হিসেবে কাজ করেছেন কি না- এসব বিষয়ের মীমাংসার জন্য এই মার্কেটের প্রতি আগ্রহ রয়েছে।”
ওই এলাকায় মানুষের প্রবেশ এখনও বন্ধ রাখা হয়েছে। লকডাউনের আগে মার্কেটে যাওয়া লোকজনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যস্ত ওই বাজারে শত শত রেড মিট, সি ফুড ও সবজির দোকান ছিল।
সম্প্রতি স্থানীয় প্রশাসন ওই এলাকা ঘিরে তৈরি করা বেষ্টনীতে চীনা ঐতিহ্যবাহী পেইন্টিংয়ের পাশাপাশি গাছ লাগিয়েছে।
গত মে মাস থেকে উহানে নতুন করে কারও কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা না পড়লেও এই মার্কেটের ওপর নির্ভর করা অনেককে এখনও ধুঁকতে হচ্ছে।
লাই নামের এক ব্যবসায়ী গত জুনে তার জাপানি খাবারের রেস্তোরাঁ নতুন করে চালু করেছেন। কিন্তু ওই মার্কেট বন্ধ থাকায় এবং আমদানি করা সি ফুড নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক থাকায় তার রোস্তারাাঁর অনেক খাদ্য উপকরণের দাম পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, “আগামী বছর আমাদের লক্ষ্য হবে কোনো রকমে শুধু টিকে থাকা।”