ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের কেনাকাটায় ‘পুকুর চুরি’
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, কেনাকাটায় সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ের (পিপিআর) নির্দেশনা মানা হয়নি।
গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়েছে। সংসদীয় কমিটি এই অনিয়ম-দুর্নীতিকে ‘পুকুর চুরি’ বলে আখ্যায়্তি করেছে। পরে এই দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়টি ‘অধিকতর’ তদন্তের জন্য কমিটির সদস্য মুহিবুর রহমান মানিককে আহŸায়ক করে সংসদীয় সাব কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাব কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আ. ফ. ম রুহুল হক, মো. আব্দুল আজিজ ও জাকিয়া নূর।
জানতে চাইলে সাব কমিটির আহŸায়ক বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে দুর্নীতির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে, অনিয়ম ও দুর্নীতির যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, বাস্তবে ঘটেছে তারও বেশি। এক কথায় বলতে গেলে ‘পুকুর চুরি’ হয়েছে। এই দুর্নীতির গভীরে যেতে সংসদীয় সাব কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সংসদীয় কমিটির বৈঠকের কার্য বিবরণী থেকে জানা গেছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে তিন পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া হয়েছে। এতে দরপত্র আহŸান থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি সরবরাহ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি ও অনিয়ম তুলে ধরা হয়েছে।
যন্ত্রপাতি কেনার দরপত্রের বিষয়ে বলা হয়েছে, একটি ইংরেজি দৈনিকে ২০১৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে ওই দরপত্র খোলার সময় দেওয়া হয়েছে, তার এক বছর আগে ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর। এতে ওই টেন্ডারের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বিষয়টিকে ‘অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
রাজস্ব খাতে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় একই বিজ্ঞপ্তিতে দু’টি অর্থ বছরের যন্ত্রপাতি কেনার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে উলেখ করে বিষয়টিকে পিপিআর (পাবলিক প্রোকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮) পরিপন্থী বলে উলেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়ের স্মারকে একটি কোড থেকে অর্থ ব্যয়ের জন্য ছাড় দেওয়া হলেও অন্য কোডে ওই অর্থ খরচ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, সরবরাহ করা যন্ত্রপাতির ছবি ই-মেইলের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। যা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দু’টি বিলের মাধ্যমে ১০টি রকমের পণ্যের বিপরীতে ১০ কোটি টাকার যে বিল দাবি করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। থ্রি-হেড কার্ডিয়াক স্টেথোসকোপ-এর ইউনিটের মূল্য এক লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকা, যা বাস্তবসম্মত নয়। বাজার দর যাচাই না করেই চড়ামূল্য দাখিল করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উলেখ করা হয়।
দরপত্রে কমিটিতে উপস্থিত সদস্যদের স্বাক্ষরযুক্ত নেই উলেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেনপনসিভ তিনটি দরদাতার মধ্যে দু’টির মালিকই একই ব্যক্তি। এমএসআর (মেডিক্যাল সার্জিক্যাল রিকুইজিট) সামগ্রী কেনার জন্য দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও কেনা হয়েছে অন্য যন্ত্রপাতি।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, দুই কোটি টাকার ওপরে কেনাকাটার জন্য সচিবের অনুমতি নেওয়ার শর্ত রয়েছে। অথচ ১০ কোটি টাকার কেনাকাটার ক্ষেত্রেও সচিবেরত অনুমতি নেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন খাতের ৩০ কোটি টাকর বিপরীতে ২০ কোটি ৬৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকার কার্যাদেশে যন্ত্রপাতির মধ্যে সব চেয়ে দামি ‘আইটেম’ হিসেবে ‘ইরিডিয়াম-১৯২ গ্রেড থেরাপি’ যন্ত্রের নাম উলেখ করা হয়েছে। যন্ত্রটি ক্যান্সার থেরাপি কাজে ব্যবহৃত হয়। তবে, পিপি, কার্যাদেশ ও চুক্তিতে ওই নামের কোনও যন্ত্র পাওয়া যায়নি। দরপত্রের সঙ্গে যে ক্যাটালগ ও বাক্স সরবরাহ করা হয়েছে, তার মধ্যে যে যন্ত্রটি সংরক্ষিত আছে, তার বৈজ্ঞানিক নাম হলো ব্রোকি থেরাপি। এর পরিবর্তে যে যন্ত্রটি সরবরাহ করা হয়েছে, সেটি কোনও যন্ত্র নয়। এতে আরও বলা হয়েছে, অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের আগেই অতিরিক্ত মূল্যের আইসিইউ যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে।
বুধবার অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিটির সদস্য আ. ফ. ম রুহুল হক, মুহিবুর রহমান মানিক, মো. মনসুর রহমান, মো. আব্দুল আজিজ ও সৈয়দা জাকিয়া নূর। এতে মন্ত্রণালয় ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।