ফকিরহাটে কৃষকদের মাঝে পার্চিং পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে
ফকিরহাট (বাগেরহাট) প্রতিনিধি
বাগেরহাটের ফকিরহাটে গ্রামীণ জনপদের কৃষকরা আগের থেকে অধীক সচেতন হয়েছে। এই অঞ্চলে আগে কৃষি অফিসের পরামর্শে তেমন আগ্রহ দেখা না গেলেও বর্তমানে কৃষি অফিসের উপর বেড়েছে আস্থা, লাভবান হচ্ছে কৃষক। সরকারী এই দপ্তরেরসেবা এখন জনগনের দৌড় গোড়ায় পৌছে যাচ্ছে। কৃষকদের যেকোন সমস্যায় এগিয়ে যাচ্ছে উপজেলা কৃষি অফিস।
বর্তমানে ফকিরহাটের কৃষকদের কাছে পার্চিং পদ্ধতি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ধান চাষে বর্তমানে এই পদ্ধতিতে বেশিই ঝুকে আছেন গ্রামাঞ্চলের কৃষকেরা। আর্থিক ক্ষতি কমানো, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন এখন সময়ের দাবি। এছাড়া, আধুনিক কৃষির জন্য চ্যালেঞ্জও বলা যায়। আর এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য নিরলস পরিশ্রমে নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হচ্ছে যা সাধারণ কৃষকদের কাছে সেই সেবা প্রদান করে যাচ্ছে কৃষি অফিস। কৃষিবিদগণ এসব প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে দ্রুতই ছড়িয়ে দিচ্ছে। যার ফলে সুফল ভোগ করছেন এই জনপদের সাধারণ কৃষকেরা। রক্ষা পাচ্ছে নির্মল পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র।
পার্চিং বলতে জমিতে উঁচু স্থানে পাখি বসার সুযোগ তৈরি করাই পার্চিং। উঁচু স্থান তৈরি করার ক্ষেত্রে বাঁশের কঞ্চি, গাছের ডালপালা এসব ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পার্চিং পোকা দমনের একটি পদ্ধতি।
উপজেলা কৃষি অফিস ও কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের বড়াতে জানা যায়, আইপিএম কৌশলের অন্যতম সবুজ প্রযুক্তি পার্চিং খুবই সহজ, কম খরচ ও পরিবেশবান্ধব পোকা মাকড় দমনের প্রযুক্তি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে পোকা ধরে খাওয়ার জন্য পাখিকে বসার জন্য জায়গার ব্যবস্থা করাই মূল উদ্দেশ্য। ফলে কীটনাশকের ব্যবহার কমে যায়। ফসলের উৎপাদন খরচ কমে। বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশকে দূষণ মুক্ত রাখা যায়। তাছাড়া পার্চিংয়ের মাধ্যমে পোকার বংশবিস্তার কমানো যায়। সহজেই পোকার বসতি ধ্বংস করা যায়। এমনকি পোকার বসতি তৈরি করার সুযোগ নষ্ট করা যায়।এছাড়াও পাখির বিষ্টা জমিতে জৈব পদার্থ যোগ করে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে।
সাধারণত বন্ধু পোকা-মাকড়গুলো খাবার সংগ্রহের জন্য বেশি বেশি নড়াচড়া ও চলাফেরা করে। অন্যদিকে ক্ষতিকর পোকা মাকড় চুপচাপ বসে রস চুষে খায় বা ফসল কেটে কেটে বা কুড়ে কুড়ে খায়। এসব চুপচাপ ক্ষতিকর পোকা ধরে খাওয়ার জন্যই একটু ঘনঘন পার্চিং দেওয়া হয়। পাখি যেন সহজেই ক্ষতিকর পোকা মাকড়দের দেখতে পায় এবং ধরতে পারে। ধান ফসলে প্রতি ০৫ শতকে ০১ টি করে পার্চিং ব্যবহার করতে হয়। যা বিঘায় প্রায় ৬টি। এভাবে একর প্রতি প্রায় ১৮টি থেকে ২০ টি পার্চিং ব্যবহার করতে হয়।
ফসল রোপনের পরপরই পার্চিং স্থাপন করতে হয়। যে সব এলাকায় বাবুই পাখি, চড়ই পাখি, টিয়া পাখি আছে, সেসব এলাকায় চাষকৃত ধানের পাকা স্তরে পার্চিং তুলে নিতে হয়। অন্যথায় পার্চিং তুলে ফেলার দরকার নেই।
এক গবেষণায় জানা যায়, একটি ফিঙে পাখি সারা দিনে কমপক্ষে ৩০ টি করে মাজরা পোকার মথ, ডিম, কীড়া ও পুত্তলী খেয়ে থাকে। একটি পাখির দ্বারা প্রতি মাসে কমপক্ষে ২ লাখ ৭০ হাজার পোকা ধ্বংস করা সম্ভব হয়।
এব্যাপারে উপজেলার আট্টাকা গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার নিজের ক্ষেত আছে, আর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা প্রায় আমাদের কাছে এসে পরামর্শ করে, তাছাড়া ক্ষেতে ঢাল পোতার ব্যাপারে আমাদের বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে
পিলজংগ ইউনিয়নের টাউন নওয়াপাড়া গ্রামের কৃষক সঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন, আগে আমরা ক্ষেতে বিষ দিতাম ক্ষতিকর পোকামাকড় মারার জন্য। তাতে আমাদের অর্থ ও খরচ হত কিন্তু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে ঢাল পোতা অর্থাৎ পার্চিং পদ্ধতি শুরু করি যার ফলে পুতে রাখা ঢালে পাখি এসে বসে এবং ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে নেই, এতে আমার আর টাকা খরচ করে বিষ কেনা লাগেনা।
বেতাগা ইউনিয়নের কৃষক অহিদ শেখ বলেন, আগেতো কৃষি অফিসারদের দেখাই যেতোনা কিন্তু এখনকার কৃষি অফিসাররা প্রায় এসে বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিয়ে যান এবং ক্ষেত পরিদর্শন করে যায়।আর আমাকে বলেছিলো পার্চিং করার কথা, তাদের কথা অনুসারে পার্চিং করে আমি সুবিধা পেয়েছি আর আমার দেখাদেখি আর কৃষি অফিসারদের পরামর্শে এখন প্রায় সবাই ক্ষেতে পার্চিং করে।
এব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নাছরুল মিল্লাতের সাথে কথা হলে তিনি বলেন,আমরা সব সময় চেষ্টা করি নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে।তারই ধারাবাহিকতায় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাবৃন্দ কৃষকদের পার্চিং সম্পর্কে উদ্ভুদ্ধ করে আসছেন।শুধু কৃষক না, কৃষকদের সাথে সাথে আমরাও মাঠে নেমে কাজ করি। চেষ্টা করে আসছি সকল কৃষকদের একত্রিত করে বোঝানোর। আর আমরা অনেকটাই সফল হয়েছি কৃষকদের পার্চিং এর ব্যপারে উদ্ভুদ্ধ করতে। আশা রাখি শুধু ফকিরহাট নই বাংলাদেশের সকল কৃষক এই পার্চিং পদ্ধতিতে আগ্রহী হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৮ই মার্চ কৃষি অফিসার, কৃষিবিদ নাছরুল মিল্লাত প্রথম এই পার্চিং পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, তারই ফল স্বরূপ একই সালের পরবর্তী মাসের ৮ই মার্চ জাতীয়ভাবে পার্চিং উৎসব পালিত হয়। এবং তিনিই এই পার্চিং উৎসবের প্রধান উদ্দোক্তা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন।