পোস্টার বদলে যাচ্ছে খাতায়
নির্বাচনী পোস্টার মাটিতে লুটানোর আগেই রূপ নিচ্ছে খাতায়, ঠোঙ্গায় কিংবা শপিং ব্যাগে।
এবারের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা পোস্টার যেন চুক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল রাজধানীবাসীর কাছে। আকাশ আড়াল করা পোস্টার ছেয়ে আছে গলিতে রাস্তায়। পরিবেশ দুষণের পাশাপাশি শহর নোংরা করার মতো পরিস্থিতিতে যখন উদ্বিগ্ন তখন অভিনব পন্থা বের করলো বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান।
‘আপনার কাছে যা বর্জ্য, অন্যের জন্য তা সম্পদ’ এই স্লোগান নিয়ে রাজধানী জুড়ে বাতিল পোস্টার সংগ্রহ করে তৈরি তারা তৈরি করছেন খাতা, ঠোঙ্গা, শপিং ব্যাগসহ আরও অনেক প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।
ব্যাতিক্রমী এই প্রয়াস সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির মিরপুর শাখার কর্মী হাবিবুর রহমান সম্রাট বলেন, “পরিত্যক্ত প্লাস্টিক, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, কাগজ, মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া ওষুধ ইত্যাদি আবর্জনা পরিবেশের উপর গুরুতর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে প্রতিনিয়ত। পরিবেশকে এই ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো এবং এই আবর্জনাগুলোর পুনরায় ব্যবহারের উপায় বের করা নিয়ে চিন্তার ঝড় চলছিলো অনেকদিন ধরেই। তারই প্রেক্ষিতে বইমেলায় আমাদের স্টলটিকে পরিত্যক্ত বর্জ্য ব্যবহার করে সাজানোর পরিকল্পনা হয়। এরই মধ্যে শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রচরণামূলক পোস্টার। ভাবনা শুরু হয় সেগুলো নিয়ে।”
তিনি আরও বলেন, “বিদ্যানন্দের শিক্ষার্থীদের সারাবছরের সকল বই-খাতা সরবরাহ করি আমরাই। ফলে প্রচুর খাতা দরকার হয় আমাদের। এমনও শিক্ষার্থী আছে যারা ক্যালেন্ডারের পেছনে লেখে, পেন্সিলে লেখা খাতা রাবার দিয়ে মুছে তা আবার ব্যবহার করে। এই খাতার চাহিদা মেটানোর উপায় দেখতে পাই আমরা নির্বাচনী পোস্টারে। ফলে ২ ফেব্রুয়ারি পোস্টার সংগ্রহের কাজ শুরু হয় মিরপুর এলাকা থেকে। প্রথমদিনের সংগ্রহীত পোস্টার নিয়ে ‘ফেইসবুক লাইভ’ করা হয়, জানানো হয় আমাদের পরিল্পনার কথা। সেখান থেকেই ব্যাপক সাড়া পেতে শুরু করি আমরা।”“এবার তিন ধরনের পোস্টার ব্যবহার হয়েছে। একপাশে ছাপানো পোস্টারগুলো ব্যবহার হচ্ছে খাতা তৈরিতে। আমাদের লক্ষ্য ৪০ হাজার খাতা তৈরি করা। দুপাশে ছাপানো পোস্টারগুলো দিয়ে তৈরি করছি ঠোঙ্গা, যা ব্যবহার হবে রমজান মাসে ইফতার বিতরণের কাজে। ‘লেমেনেটিং’ করা পোস্টার দিয়ে তৈরি করছি শপিং ব্যাগ। পোস্টার ঝোলানোতে ব্যবহৃত দড়ি ব্যবহার হচ্ছে হাতল হিসেবে।”
“এছাড়াও ‘লিফলেট’গুলোর অপরপৃষ্ঠা ব্যবহার করছি ১ টাকায় চিকিৎসা প্রকল্পে চিকিৎসকের পরামর্শপত্র বা ‘প্রেশক্রিপশন’ হিসেবে। এছাড়াও আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কাজেও সেগুলো ব্যবহার করছি।”
পোস্টার সংগ্রহের পদ্ধতি সম্পর্কে সম্রাট বলেন, “প্রতিটি এলাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে আমরা নিজেরাই পোস্টার সংগ্রহ করছি। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় মানুষ পোস্টার সংগ্রহ করে আমাদের জানাচ্ছেন, আমরা নিজ উদ্দ্যোগে তা সংগ্রহ করে আনছি। সাড়া পাচ্ছি নির্বাচিত অনির্বাচিত মেয়র, কাউন্সিলরদের কাছ থেকেও। প্রচারণার জন্য ছাপানো বাড়তি পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার ইত্যাদি তাদের অফিস থেকে সংগ্রহ করা জন্য তারা ডেকে পাঠাচ্ছেন আমাদের।”
কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে সম্রাট বলেন, “অব্যবহৃত পোস্টার ব্যবহারে সমস্যা হচ্ছে না ঠিক, তবে সংগ্রহ করে আনা ঝুলন্ত অনেক পোস্টার ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। দুমড়ানো, ছেঁড়া, দাগ লেগে যাওয়া অনেক পোস্টার কোনোভাবেই কাজে লাগাতে পারিনি। তাই যারা সংগ্রহ করছেন তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে পোস্টারগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করে আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।”০১৮৭৮১১৬২৩৪ এই নম্বরে ফোন করে জানাতে পারেন সংগ্রহ করা পোস্টার দেওয়ার জন্য। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পৌঁছে যাবে নির্দিষ্ট ঠিকানায়।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের চারতলায় চলছে খাতা বানানোর কাজ। সেখানেই কর্মরত ছিলেন সেচ্ছাসেবক দিপ্তী চৌধুরি।
তিনি বলেন, “২০১৫ সালে চাকরি করতাম, এখন গৃহিনী। সেসময় সহকর্মীদের বরাত দিয়েই পরিচয় হয় বিদ্যানন্দের সঙ্গে। কাজ শুরু করি তাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে। তারপর চাকরি ছেড়ে দিলেও বিদ্যানন্দ ছাড়তে পারিনি। সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা করে সময় দেই। অর্থ নয়, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পারার তৃপ্তির লোভেই কাজ করে যাচ্ছি।”
আরেক সেচ্ছাসেবক আফরোজা আক্তার। সাবেক এই সংবাদকর্মী নারায়নগঞ্জ থেকে এসে সময় দেন বিদ্যানন্দে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সম্রাট বলেন, “পরিত্যাক্ত বস্তুর পুনর্ব্যবহারের প্রয়াস এখানেই শেষ নয়। পুরনো ‘পিভিসি ব্যানার’ দিয়ে স্কুলব্যাগ, রেইনকোট বানানোর চেষ্টা করছি আমরা। পলিথিন গলিয়ে তাবু ও তেরপল বানানোর চেষ্টাও চলছে, যা ভাসমান মানুষদের রাতে মাথা গোজার ঠাঁই হিসেবে ব্যবহার হবে। এসব কাজে পেশাদারী সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।”
“খাতার প্রয়োজন আমাদের বরাবরই থাকবে, তাই সর্বস্তরের মানুষের প্রতি অনুরোধ কাগজ দিয়ে সাহায্য করার জন্য। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করছি আমরা। এখানকার শিক্ষার্থীদের জমা দেওয়া ‘অ্যাসাইনমেন্ট’য়ের কাগজগুলোর একপৃষ্ঠা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অব্যবহৃত থাকে এবং একবার তা শিক্ষকদের দেখা হয়ে গেলে বাতিল হিসেবেই গণ্য হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই কাগজগুলো আমাদের হাতে তুলে দিলে তা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খাতা হিসেবে ব্যবহার হতে পারে সহজেই।”বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের মধ্যে আছে ১ টাকায় আহার, ১ টাকায় চিকিৎসা, ১ টাকায় আইনি সেবা, ইফতার বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ ইত্যাদি। তাদের সেচ্ছাসেবক হওয়ার প্রক্রিয়াও সহজ, ফোন করে তাদের কার্যালয়ে গিয়ে কাজে লেগে পড়লেই হল। রেজিস্ট্রেশনও সেখানেই হয়ে যাবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, রাজবাড়ি, রাজশাহী, রংপুর তাদের কার্যালয় আছে। প্রয়োজনীয় সকল যোগাযোগ মাধ্যম মিলবে তাদের ফেইসবুক পেইজে।