পেঁয়াজের ঝাঁঝ যেন তেল-চিনিতে না লাগে, সরকারকে পরামর্শ
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
পেঁয়াজকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির উপর নজর রেখে রোজার আগে ভোজ্য তেল ও চিনির বিষয়ে সতর্ক থাকতে সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। গত এক সপ্তাহে প্রায় সব ধরনের সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটারে এবং চিনির দাম কেজিতে অন্তত ৫ টাকা বেড়েছে। বিশ্ব বাজারে দাম বেড়ে যাওয়াকে এর কারণ দেখাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন, গত দুই মাস ধরে বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের বাজার অস্থিতিশীল। বাজার অনেক বেড়ে গেছে। আবার কখন এই বর্ধিত বাজার কমে যায়, সে কারণে অনেক সতর্ক আমদানিকারক আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। চিনির দাম বাড়ার ক্ষেত্রেও একই কারণ দেখান আমদানিকারক সিটি গ্রæপের মহা ব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা।
মজুদের সঙ্কট নেই বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করলেও অর্থনীতির গবেষক সেলিম রায়হান বলছেন, বিশ্ব বাজারে যখন দাম বাড়ছে, তখন সরকারকে আগাম সতর্ক অবস্থান নিতে হবে। এ বছর পেঁয়াজের দামের অস্ভাবিক বৃদ্ধি সরকারকে বেশ ভুগিয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বৃহস্পতিবারই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছেন, তিনি এখন বসবাস করছেন ‘আগুনের মধ্যে’।
আসছে রোজায় যেন দ্রব্যমূল্য না বাড়ে, সেজন্য ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চাইছেন তিনি। কিন্তু রোজার প্রায় চার মাস আগে বাজার ঘুরে ভোজ্য তেল ও চিনির বাজারে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের মুদি দোকানি হাবিবুর রহমান বৃহস্পতিবার বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। প্রথম পর্যায়ে মোড়কে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) না বাড়িয়ে কেবল মুনাফার হার কমিয়ে দিয়েছিল পরিবেশকরা। পরে ঘোষিত খুচরা মূল্যও বাড়ানো হয়েছে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বসুন্ধরা ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের দুই লিটারের বোতলের এমআরপি ২০২ টাকা। আগে এই বোতল ১৮০ টাকায় কিনে ১৯০ টাকায় বিক্রি করতাম। এখন ১৯০ টাকার বেশি দামে কেনা পড়ছে, তাই বিক্রি করছি ২০০ টাকায়।
এই বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, পুষ্টি ব্র্যান্ডের এক লিটার সয়াবিন তেলের এমআরপি ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১০ টাকা করা হয়েছে। বসুন্ধরার ৫ লিটারের বোতলের এমআরপি ৫০৬ টাকা ঠিকই আছে। তবে বসুন্ধরার ৫ লিটার বোতল সম্পর্কে হাবিব বলেন, দুই সপ্তাহ আগে এই বোতল পরিবেশকরা ৪৩০ টাকায় সরবরাহ করত। এখন দিচ্ছে ৪৫৫ টাকায়। ফলে এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ৪৮০ টাকায়।
বাজারে রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের এক লিটারের বোতলের এমআরপি ছিল ১০৫ টাকা। সেটা প্রথম ধাপে বাড়িয়ে ১১০ টাকা এবং দ্বিতীয় ধাপে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়েছে বলে মহাখালী কাঁচাবাজারের মুদি দোকানি লুৎফুর রহমান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, একইভাবে তীর ব্র্যান্ডের এক লিটারের বোতল এখন ১১০ টাকা। স্বাদ ব্র্যান্ডের রাইস ব্রান তেলের ৫ লিটারের এমআরপি ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৮০ টাকা করা হয়েছে। চিনির খুচরা দামও ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ টাকা এবং প্রতিকেজি প্যাকেট চিনির দাম ৭০ টাকা হয়েছে বলে জানান লুৎফর।
ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ভুট্টো বলেন, পাম তেলের প্রধান রপ্তানিকারক ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া স¤প্রতি তাদের রপ্তানি কমিয়ে দেওয়া ও দাম বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে তেলের বাজারে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দামও বেড়ে চলছে।
তিনি বলেন, কখন এই বর্ধিত মূল্য হঠাৎ করে কমে যায়, মিলাররা সেই ভয়ে আছেন। সে কারণে তারা তেল আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন।
তেল ও চিনির মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সিটি গ্রæপের মহা ব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিসহ দেশীয় কিছু কারণে তেল-চিনির দাম বাড়ছে। তেল লিটারে ৫ টাকা করে বাড়াতে হয়েছে। রোজাকে সামনে রেখে এই মুহূর্তে আমদানির এলসি খুলতে হলে সেই তেলের দাম আরও বাড়াতে হবে। কারণ কেউ তো লস দিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলের বাণিজ্য পরামর্শক গোলাম খোরশেদ বলেন, যেহেতু সয়াবিন তেল আমদানিনির্ভর, তাই বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে পারে। তবে বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ার কথা বলে কোম্পানিগুলো অযৌক্তিক দাম বাড়াচ্ছে কি না, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, দেশে আড়াই-তিন লাখ টন সরিষার তেল (দেশীয়), প্রায় ২০ লাখ টন সয়াবিন তেল, দুই লাখ টন পাম তেলের চাহিদা রয়েছে। এর বাইরে সানফ্লাওয়ার ও রাইচ ব্রান তেলসহ মোট ২৪ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। আমদানি সচল থাকায় দেশে বর্তমানে ভোজ্য তেলের মজুদে কোনো সঙ্কট নেই বলে দাবি করেন খোরশেদ।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে পাম তেল আমদানি করা হয়। আর সয়াবিন তেল আমদানি করা হয় ব্রাজিল ও সিঙ্গাপুর থেকে। বাজারে যে কোনো ধরনের অস্থিরতা এড়াতে সঠিক চিত্রের ধারণা নিয়ে আগাম সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, সয়াবিন, পাম তেল ও চিনির ক্ষেত্রে বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধির কথা বলা হলেও একটি বিষয় দেখা যায়, তা হচ্ছে বাংলাদেশে বিশ্ব বাজারের তুলনায় দাম অনেক বেশি থাকে।
সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধির এই সময়ে ব্যবসায়ীরা সতর্কতামূলকভাবে আমদানি কমিয়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মজুদের বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পেঁয়াজের মতো আরেকটি পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়।
তথ্যের সঠিকতার উপর জোর দিয়ে সেলিম বলেন, চাহিদা ও জোগান নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের থাকতে হবে। এই বিষয়গুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশ কীভাবে সামাল দেয়, সেই ধারণাও সামনে রাখতে হবে।