পুলিশি নির্মমতার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে সংহতি
মিনিয়াপোলিসে পুলিশ হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে চলমান বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিশ্বজুড়ে কর্মসূচি অব্যাহত আছে।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেয়া বিধিনিষেধ আর সরকারগুলোর সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে এসব কর্মসূচিতে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিচ্ছে বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
শান্তিপূর্ণ এসব কর্মসূচিতে অংশ নেয়া অনেকের মুখে মাস্ক থাকলেও তাদের কণ্ঠ থেকে সজোরে ধ্বনিত হচ্ছে ‘জর্জ ফ্লয়েড’, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’, ‘নো জাস্টিস নো পিস’ স্লোগান।
করোনাভাইরাসজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা উল্লেখ করে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন শনিবারের ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ শোভাযাত্রায় অংশ না নিতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাও দেশটির কয়েক হাজার মানুষকে বর্ণবাদবিরোধী কর্মসূচিগুলো থেকে দূরে রাখা যায়নি।
লন্ডন, ম্যানচেস্টার ও বার্মিংহামের মতো শহরগুলোতে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বর্ণবাদবিরোধী কর্মসূচিগুলোতে জমায়েত না হতে অনুরোধ ছিল ব্রিটেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
মহামারীর মধ্যে আলাদা আলাদা বাড়ির ছয়জনের বেশি একত্রিত হলে বিধিনিষেধের লংঘন বলে বিবেচিত হতে পারে- পুলিশের এমন সতর্কবার্তা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা আবহাওয়ার মধ্যেও যুক্তরাজ্যজুড়ে ঠিকই কর্মসূচিগুলোতে ভিড় দেখা গেছে।
প্যারিস থেকে বার্লিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে শনিবার হাজার হাজার মানুষ পুলিশ হেফাজতে নিহত ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়েছে।
গত সপ্তাহে জাপান, সুইডেন ও জিম্বাবুয়েতেও একই দাবিতে নানান প্রতিবাদ কর্মসূচি দেখা গেছে।
শনিবার স্থানীয় সময় বিকালে লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কয়ারে কয়েক হাজার মানুষ বর্ণবাদবিরোধী স্লোগান দেন এবং ফ্লয়েডের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ভিডিও ফুটেজে কয়েকশ আন্দোলনকারীকে যুক্তরাজ্যের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের দিকে হেঁটে ও গাড়িতে যেতে দেখা গেছে; এসময় অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের বিরুদ্ধে টিটকারি দিচ্ছিলেন ও হর্ন বাজাচ্ছিলেন।
ভেজা মাটিতে হাঁটু গেড়ে সবাই যখন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সংহতি জানাচ্ছিলেন তখন সেই জমায়েতে ছিল পিনপতন নীরবতা। অনেককে এসময় মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে ধরতে দেখা গেছে।
প্যারিসে কর্তৃপক্ষের বাধা উপেক্ষা করেই শনিবার বিকালে কয়েক হাজার মানুষ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সামনে জড়ো হয়েছিলেন। বিক্ষোভ হয়েছে আইফেল টাওয়ারের কাছেও। এসব বিক্ষোভে প্রতিধ্বনিত হয়েছে অ্যাডামা ত্রায়োরের নামও, ২০১৬ সালে যিনি ফ্রান্সে পুলিশ হেফাজতে মারা যান। গত সপ্তাহে ত্রায়োরের স্মরণে হওয়া বিক্ষোভে প্রায় ২০ হাজারের মতো মানুষ অংশ নিয়েছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেই সিডনি ও মেলবোর্নের মতো শহরগুলোতে জড়ো হওয়া হাজার হাজার মানুষ পদ্ধতিগত বর্ণবাদ ও পুলিশ হেফাজতে আদিবাসীদের মৃত্যুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পুলিশ হেফাজতে প্রায় ৪০০ আদিবাসী নিহত হলেও এসব ঘটনায় কখনোই কোনো পুলিশ সদস্য অভিযুক্ত হয়নি।
করোনাভাইরাসজনিত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করায় জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে- এমন সতর্কতা উপেক্ষা করেই অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে হাজারো মানুষ মাস্ক পরে উপস্থিত হয়ে ‘অস্ট্রেলিয়াও নিষ্পাপ নয়’, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’ স্লোগান দেয়।
মেলবোর্নে সংহতি জানাতে আসা অনেকের হাতে আদিবাসীদের পতাকা, চিহ্ন ও নানান প্রতীক দেখা গেছে। এখানেও স্লোগান ওঠে ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় পুলিশ হেফাজতে নিহত আদিবাসী ডেভিড ডাঙ্গেরও শেষ আকুতি ফ্লয়েডের মতোই ছিল ।
শুক্রবার রাতে অস্ট্রেলিয়ার একটি আদালত করোনাভাইরাস মহামারীতে সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উল্লেখ করে সিডনির বিক্ষোভ কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, এতে শহরটিতে শনিবারের কর্মসূচি ঘিরে ব্যাপক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
আয়োজকরা পরে আদালতের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ আগে কর্মসূচির ছাড়পত্র মেলে।
শনিবার অস্ট্রেলিয়ায় বেশিরভাগ কর্মসূচির চারপাশে পুলিশ অবস্থান করলেও তারা প্রতিবাদকারীদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করেননি। কোথাও কোথাও সংহতি জানাতে আসা মানুষের সংখ্যা আয়োজকদের ধারণাকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে।
বর্ণবাদবিরোধী এসব কর্মসূচিতে ক্ষোভের সঙ্গে মিশে ছিল সংকল্পও।
“আমরা চুপ থাকবো না,” সিডনির সমাবেশে অংশ নেয়া হাজার হাজার মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন আয়োজকদের একজন।
সমাবেশে অংশ নেয়া অনেকের মতে, শনিবারের এ কর্মসূচি বন্ধের চেষ্টাই বর্ণবাদের অন্যতম নজির। ফার্মার্স মার্কেটগুলোর মতো যেসব জায়গায় শ্বেতাঙ্গরা জমায়েত হন, করোনাভাইরাস বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সেগুলো নির্বিঘ্নেই চলছে বলে অভিযোগ করেছেন বলছেন তারা।
সিডনিতে সমাবেশ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লয়েডের জন্য কর্মসূচি অস্ট্রেলিয়ায় পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পরিণত হয়।
‘নো জাস্টিস, নো পিস, নো রেসিস্ট পুলিশ’, ভিড় থেকে স্লোগান ওঠে। কিছু সময় পর আন্দোলনকারীরা শহরের ব্যস্ত কেন্দ্রস্থলের দিকে শোভাযাত্রা নিয়ে অগ্রসর হন।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তাহে ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের বিষয় অভিহিত করে তা নিয়ে আন্দোলনের নামে বিক্ষোভকারীরা ‘সমস্যা আমদানি’ করছে বলে অভিযোগ করেছিলেন।
“না মরিসন, অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্র নয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার আছে নিপীড়নের দীর্ঘ অন্ধকারাচ্ছন্ন নির্মম অতীত,” জবাবে এমনটাই বলেছেন অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত আফ্রিকান-আমেরিকান রন বেয়ার্ড।
হামবুর্গ ও ফ্রাঙ্কফুর্টের মতো শহরগুলোতে বিক্ষোভের এক সপ্তাহ পর জার্মানিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা মিনিয়াপোলিসে নিহত ফ্লয়েডের সম্মানে মানুষজনকে বিভিন্ন শহরের সড়কে নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছে।
ডয়েচ ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে ফ্লয়েডের মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেছেন।
“এটা বর্ণবাদী ঘটনা। কিন্তু আমি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের শক্তির উপর আস্থা রাখছি; তারা এ সংকটকালীন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে,” বলেছেন তিনি।