November 26, 2024
জাতীয়লেটেস্ট

পারিবারিক আদালত অবমাননার দন্ড ২০০ টাকা যথেষ্ট নয় : হাই কোর্ট

 

দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক

পারিবারিক আদালত অবমাননায় শাস্তির বিধান আরও কঠোর করা দরকার বলে মনে করছে হাই কোর্ট। এর জন্য বিদ্যমান বিধান সংশোধন করে অবমাননাকারীকে সিভিল জেল ও পর‌্যাপ্ত জরিমানা করার বিধান রাখার পক্ষে মত দিয়েছে উচ্চ আদালত। সেই সথে সরকারের নীতি নির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। শিশু সন্তানের হেফাজত সংক্রান্ত এক রিট মামলার (হেবিয়াস করপাস) রায়ে এ পর‌্যবেক্ষণ এসেছে।

গত ৭ নভেম্বর এ রায় দিয়েছিল বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সে রায়টি প্রকাশ করা হয়েছে। পাঁচ পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন বিচারপতি এম. ইনয়েতুর রহিম। তার সাথে একমত হয়েছেন বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক মো. মোস্তাফিজুর রহমান।

হাই কোর্ট পর‌্যবেক্ষণে বলেছে, সা¤প্রতিক সময়ে হাই কোর্ট বিভাগের এই বেঞ্চে শিশুর মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ, মনোমালিন্য, দাম্পত্য কলহসহ বিভিন্ন কারণে শিশুদের হেফাজত নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা (হেবিয়াস র্ক্পাস) পরিচালনা করতে হয়েছে এবং হচ্ছে।

সে অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে আদালত রায়ে বলেছে, দীর্ঘ সময় ধরে পারিবারিক আদালতে মামলা চলছে। ২০১০, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মামলাগুলো এখনো বিচারাধীন। শিশুদের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত সংক্রান্ত মামলা এত দীর্ঘ সময় ধরে বিচারাধীন থাকা দুঃখ ও হতাশাজনক এবং ন্যায়-নীতির পরিপন্থী। এসব মামলা দ্রæত নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।

যে কারণে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চ আদালত শিশু সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত সংক্রান্ত মামলা দায়েরের ছয় মাসের মধ্যে পারিবারিক আদালতকে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় পর্যবেক্ষণে।

সেখানে আরও বলা হয়, পারিবারিক আদালতের বিভিন্ন আদেশ, বিশেষ করে শিশু সন্তানের সাথে দেখা-সাক্ষাতের আদেশ সংশ্লিষ্ট পক্ষ মানছে না। যে কারণে তারা হাই কোর্টে এসে এসে হেবিয়াস র্কপাস অধিক্ষেত্রে আশ্রয় গ্রহণ করছেন।

পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৮৫ এর ১৯ ধারা অনুযায়ী পারিবারিক আদালতকে অবমাননা করা হলে অবমাননাকারীকে মাত্র ২০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, পারিবারিক আদালত অবমাননায় শাস্তির এই বিধানটি সংশোধন করে আরও কঠোর করা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে সিভিল জেল এবং পর্যাপ্ত জরিমানার বিধান প্রণয়ন সময়ের বাস্তবতা। আদালত প্রত্যাশা করে সরকারের নীতি নির্ধারক মহল এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

রায়ে উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, ২০১১ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিয়ের চার বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি এক দম্পত্তি ঘরে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানের জন্মের দিন বাবা সেখানে ছিলেন না। জন্মের পর থেকে মা সন্তানের লালন-পালনসহ সব দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। যদিও আর্থিক খরচ বহন করে আসছিলেন বাবা।

এ অবস্থায় মনোমালিন্য, মতবিরোধ, শারীরিক-মানসিক নির‌্যাতন ও পারিবারিক দ্ব›েদ্বর জেরে ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর স্বামীকে তালাকের নোটিস পাঠান ওই নারী। এ নোটিস পাওয়ার পর স্ত্রীকে না জানিয়ে তিন বছরের শিশুটিকে নিয়ে রাজশাহী চলে যায় বাবা। সেই থেকে শিশুটি বাবার কাছেই আছে। শিশুটির মা ঢাকার মিরপুরে ডিওএইচএস-এ তার বাবার বাসায় থাকেন।

এরপর শিশুটির মা রাজশাহী গিয়ে সন্তানের সাথে দেখা করতে চাইলেও সে সুযোগ দেয়নি শিশুটির বাবা। এর মধ্যে শিশুটির বাবা দ্বিতীয় বিয়েও করেছেন। এ অবস্থায় ২০১৯ সালের ২৩ ও ২৬ জানুয়ারি ও ২০ মে সন্তানকে দেখতে আত্মীয়-স্বজনসহ রাজশাহী যান শিশুটির মা। কিন্তু শিশুটির বাবা সন্তানকে তার মায়ের সাথে দেখা করতে দেয়নি। এ অবস্থায় সন্তানের হেফাজত চেয়ে হাই কোর্টে এসে রিট আবেদন করেন ওই নারী।

এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারি করলে রুলের জবাব দেয় শিশুটির বাবা। সেখানে বলা হয়, জন্মের ছয় মাসের মাথায় শিশুটির মা তাদের ছেড়ে চলে যায়। পরে একজন গৃহপরিচারিকার মাধ্যমে শিশুটির পরিচর‌্যা করে আসছিলেন। ২০১৯ সালে কর্মস্থল বদলির কারণে শিশিুটিকে নিয়ে ঢাকা থেকে রাজশাহী চলে যান তিনি। পরে ২০২০ সালে ১১ ডিসেম্বর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

রাজশাহীতে এসে সন্তানের সাথে দেখা করতে চাইলে সে সুযোগ দেওয়া হয়েছে শিশুর মাকে। কিন্তু বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। শিশুটিও মার হেফাজতে যেতে রাজি নয় বলেও জবাবে বলা হয়েছে।

রুলের জবাব দেওয়ার পাশাপাশি নির্দেশ অনুযায়ী সন্তানকে নিয়ে আদালতে হাজির হন বাবা। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস সন্তানের সাথে মার সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দেয়। এদিকে আদালত বিষয়টি সমঝোতা করার সুযোগ দিলেও শেষ পর‌্যন্ত সমঝোতায় আসতে পারেনি শিশুটির মা-বাবা। পরে আদালত পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে রুলটি নিষ্পত্তি করে রায় দেয় হাই কোর্ট।

রায়ে বলা হয়, হেবিয়ার্স কর্পাস রিট মামলায় শিশুর অভিভাবকত্ব নির্ধারণের সুযোগ নেই; সংশ্লিষ্ট পারিবারিক আদালতেই তা নির্ধারিত হবে। রায়ে পারিবারিক আদালতে শিশুর মায়ের করা মামলা ৩১ মার্চের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। সংশ্লিষ্ট মামলার পক্ষদের এ বিষয়ে আদালতকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

রায়ে আরও বলা হয়, বর্তমান মামলার সামগ্রিক পেক্ষাপট ও পরিস্থিতি বিশেষ করে শিশুটির সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মামলাটি (পারিবারিক আদালতে) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শিশুটি বাবার হেফাজতে থাকবে।

শিশুর মা রাজশাহীতে শিশুর বাবার বাসায় অথবা রাজশাহী শহরের যে কোনো জায়গায় সন্তানের সাথে দেখা ও একান্তে সময় কাটাতে পারবেন। তবে রাজশাহী শহরের বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন না। এ বিষয়ে শিশুর বাবাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয় রায়ে।

 

 

 

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *