পণ্য পরীক্ষায় লেনদেনের খবর পেলে জেলে পাঠিয়ে দেব : হাই কোর্ট
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
ঢাকাসহ সারাদেশে সব পণ্যের মান দৈবচয়ন ভিত্তিতে পরীক্ষা এবং পুনঃপরীক্ষা করতে বিএসটিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। বিচারক বলেন, এরকম অভিযোগ আছে যে টেস্ট-রিটেস্টের আগে লেনদেন হয়। এরকম খবর পেলে দুদকে না পাঠিয়ে সরাসরি জেলে পাঠিয়ে দেব।
গতকাল রবিবার একটি রিট মামলার শুনানিতে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে এমন হুঁশিয়ারি আসে। এছাড়া ভোক্তাদের জরুরি সেবা দিতে আগামী দুই মাসের মধ্যে একটি হটলাইন চালু করতে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
আদালত বলেছে, ওই হটলাইন চালুর আগ পর্যন্ত ভোক্তা অধিকার সংক্ষরণ অধিদপ্তরের একটি নম্বর (০১৭৭৭৭৫৩৬৬৮), প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ৩৩৩ এবং জাতীয় হটলাইন ৯৯৯ এর মাধ্যমে ভোক্তাদের ছুটির দিনসহ ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা দিতে হবে।
বিচারক বলেন, ওই দুটি নম্বর যেন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নম্বরটিও ছুটির দিনসহ ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখতে হবে। বিষয়টি ভোক্তাদের জানানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিএসটিআইর মানের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বিভিন্ন কোম্পানির খাদ্যপণ্য বাজেয়াপ্ত বা তুলে নিয়ে ধ্বংস করার নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হককে তলব করেছিল হাই কোর্ট। কেন তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে গত ২৩ মে রুলও জারি করা হয়েছিল।
সে অনুযায়ী মাহফুজুল হক রবিবার আদালতে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে নিশঃর্ত ক্ষমা চান। আদালত তাকে শর্তসাক্ষেপে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আতালত অবমাননার প্রশ্ন জারি করা রুলটি নিষ্পত্তি করে দেয়।
শর্তগুলো হল- মাহফুজুল হক আর কখনো আদালতের আদেশ-নির্দেশ লঙ্ঘন করবেন না। বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় যে ৫২টি নিম্নমানের পণ্য ধরা পড়েছে শুধু সেই ৫২টি পণ্য নয়, খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রাখবেন। যেহেতু নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জনবল সঙ্কটের কথা বলেছে, তাই সরকারের অন্যান্য ‘এজেন্সির’ সহযোগিতা নিয়ে ভেজালবিরোধী অভিযান তিনি অব্যাহত রাখবেন।
বিএসটিআইয়ের পক্ষে এদিন আদালতে ছিলেন আইনজীবী সরকার এম আর হাসান। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের পক্ষে ছিলেন কামাল উল আলম, এম আমিনুদ্দিন এবং মোহাম্মদ ফরিদুল আলম। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষে ছিলেন কামরুজ্জামান কচি।
এছাড়া রিটকারী পক্ষে শিহাব উদ্দিন খান এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান শুনানিতে অংশ নেন। শিল্প মন্ত্রণালয় গত ২ মে এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বিএসটিআই রোজার আগে বাজার থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে ১৮টি কোম্পানির ৫২টি নিম্নমানের পণ্য চিহ্নিত করেছে।
এরপর এসব খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার, জব্দ ও মান উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনশাস কনজ্যুমার সোসাইটির (সিসিএস) পক্ষে এই রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান।
ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি করে গত ১২ মে বিএসটিআইর মানের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ১৮টি কোম্পানির ৫২টি পণ্য বিক্রি বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। সেই সঙ্গে উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এছাড়া বাজারে থাকা এসব নিম্নমানের পণ্য বাজার থেকে দ্রুত বাজেয়াপ্ত, অপসারণ করে ধ্বংস এবং মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তার উৎপাদন ও বাজারে সরবরাহ বন্ধ রাখতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।
এসব নির্দেশ দ্রুত বাস্তবায়ন করে আগামী ১০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী গত ২৩ মে হাই কোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু সেখানে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতির তথ্য না থাকায় উষ্মা প্রকাশ করে হাই কোর্ট।
বিচারক বলেন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আদালতের আদেশ অনুযায়ী দেশের কোথাও কোনো দোকান থেকে একটি প্যাকেটও সরায়নি। এ সংক্রান্ত একটি শব্দও তাদের প্রতিবেদনে নেই।
এরপর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হককে ১৬ জুন আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। পাশাপাশি জারি করা হয় আদালত অবমাননার রুল, যার নিষ্পত্তি করা হল রবিবার।
এদিকে যে ৫২টি পণ্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিল বিএসটিআই, কয়েক ধাপে পরবর্তী পরীক্ষার তার মধ্যে ২৬টিকে ওই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এছাড়া গত ১১ জুন দ্বিতীয় দফায় ২২টি পণ্যকে ‘নিম্ন মানের’ বলে ঘোষণা করে জাতীয় মান নির্ধারণকারী সংস্থা বিএসটিআই।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল ইসলাম আদেশের পর সাংবাদিকদের বলেন, “গতবার যে হলফনামা আমরা দিয়েছিলাম, সেখানে ভুলবশত আমাদের কার্যক্রমের রিফ্লেকশনটা সঠিকভাবে হয়নি। সারা বাংলাদেশে আদালতের নির্দেশমত যে ড্রাইভ দিয়েছি তার একটা রিপোর্ট আমরা আজ সাবমিট করেছি।
আদালত আমাদের রিপোর্টে এবং আবেদনে সন্তুষ্ট হয়ে কিছু শর্ত দিয়ে তাকে (মাহফুজুল হক) ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। উনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার যে রুল হয়েছিল, সেটাও নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন।
রিটকারী আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান সাংবাদিকদের বলেন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং বিএসটিআইকে আদালত নির্দেশ দিয়েছে, আগামী ধার্য তারিখে বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দিতে হবে, তারা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছেন কি না।
আর হটলাইন চালু এবং খাদ্যে ভেজাল রোধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকেও আদালত প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে বলে জানান তিনি। আগামী ১৯ আগস্ট এসব বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দিতে হবে জানিয়ে শিহাব বলেন, আদালত বলেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নম্বরটা অফিস আওয়ারে (৯ থেকে ৫টা) চালু থাকে, এটা যথেষ্ট না। এটা ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হবে। তাছাড়া ছুটির দিনেও যাতে অধিদপ্তরে লোকবল থাকে, তারা যেন কাজ করে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আইনজীবী কামরুজ্জামান কচি সাংবাদিকদের বলেন, ৫২টি পণ্যের মধ্যে ৪২টি পুনঃপরীক্ষা করা হয়েছিল। তার মধ্যে ২৬টি পণ্য মানোত্তীর্ণ হয়েছে। নিম্নমানের ১৬টি পণ্যের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এ বিষয়টি আদালতে জানানো হয়েছে।
আদালত বলেছে, এই ১৬টি পণ্য আবার যদি পুনঃপরীক্ষার আবেদন করে এবং মানোত্তীর্ণ হয়, পণ্যগুলো আবার বাজারে আসতে পারবে। আদালত নিম্নমানের পণ্যগুলো কোম্পানির নিজ দায়িত্বে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাজার থেকে তুলে নিতে নির্দেশ দিয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী।