নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তি করায় সংসদে রাঙ্গাকে তুলাধুনা
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক শহীদ নূর হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তিপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ায় জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব ও সংসদের বিরোধীদলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাকে তুলাধুনা করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাকে দুঃখ প্রকাশ করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে বলেও দাবি জানানো হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে রাঙ্গাকে তুলাধুনা করে ক্ষমা চাইতে বলেন সংসদ সদস্যরা। একইসঙ্গে তাকে জাপা থেকে বহিষ্কার এবং তার এই ধরনের কটূক্তিতে জাপার কাছে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় সংসদে তার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংসদ সদস্যরা।
অধিবেশন চলাকালীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি রাঙ্গার দল জাপার সিনিয়র সদস্যরাও তাকে তুলাধুনা করেন। পাশাপাশি রাঙ্গা কীভাবে সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ এবং জাপা মহাসচিব হলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তার দলের লোকেরা।
মাগরিব নামাজের বিরতির পর অধিবেশনে পর পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে এই প্রসঙ্গ টেনে তাহজীব আলম সিদ্দীকি বলেন, নূর হোসেন দিবসে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন জাপা মহাসচিব ও সংসদের বিরোধীদলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা। নূর হোসেনকে হত্যার পর সারাদেশের আনাচে কানাচে স্বৈরারাচারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং হাজারো নূর হোসেনের জন্ম হয়। সেই নূর হোসেনকে নিয়ে অপমানজনক বক্তব্যের প্রতিকার চাই। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। একইসঙ্গে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে।
এরপর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, রাঙ্গা এমন একটি বক্তব্য দিয়েছেন, যেটাতে বাংলার মানুষের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। নূর হোসেন হত্যার ঘটনার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয় এবং মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আমি অবাক হলাম রাঙ্গা বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নূর হোসেনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অথচ রাঙ্গা ভুলে গেছেন এরশাদও নূর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তার মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল, সংসদে ক্ষমা চেয়েছিল। রাঙ্গা তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। তার এই বক্তব্যের ধিক্কার জানাই।
‘এরশাদের বক্তব্যের জন্য আমরা প্রশংসা করেছিলাম। কিন্তু রাঙ্গার বক্তব্যের কারণে সারাদেশে স্বৈরাচার শব্দটি উচ্চারণ হচ্ছে। রাঙ্গা যে বক্তব্য দিয়েছেন, এর জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি যে এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই এলাকায় আওয়ামী লীগ তার সঙ্গে না থাকলে নির্বাচিত হতে পারতেন কিনা সেটা আমরা বলতে চাই না। রাঙ্গা খুবই খারাপ বক্তব্য দিয়েছেন। আমি তার বক্তব্যে ঘৃণা প্রকাশ করি। সবাই এখন স্বৈরাচারী এরশাদ বলছে। একজন সুস্থ্য মানুষ, তিনি যদি স্বাভাবিক থাকেন তার পক্ষে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও নূর হোসেনকে নিয়ে এই বক্তব্য দেওয়া সম্ভব না,’ যোগ করেন তোফায়েল আহমেদ।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। রাঙ্গা সেই চেষ্টা করেছেন। নূর হোসেন যখন হত্যা হয়, তখন দেশে ফেনসিডিল-ইয়াবা ছিল না। ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু’র কথা বলা হয়। এই ভোট ডাকাতি-মিডিয়া ক্যু’র মূলহোতা ছিল এরশাদ। আজ সেটাকে ঢাকার জন্য রাঙ্গা এত বড় দুঃসাহস দেখাতে পারে না। এরশাদের সময় রাজনৈতিক নেতাদেরকে নির্যাতন ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। এরশাদকে শুধু আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার বলে না, সারাদেশের মানুষ তাকে স্বৈরাচার বলে অভিহিত করেছে। বিশ্বে স্বৈরাচার বলে পরিচিতি পেয়েছে। রাঙ্গাকে অবশ্যই তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।
গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, নূর হোসেনকে নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন রাঙ্গা। কথায় আছে ‘রতনে রতন চেনে….’। আমি বাকি কথাটা আর বললাম না। যে নূর হোসেনকে সামনে রেখে আমরা আন্দোলন করেছি। তাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। এটা করে তিনি সংসদকে অপমান করেছেন। কারণ স্বৈরাচারের পতন না হলে তিনি সংসদে এসে বসতে পারতেন না। একথা বলে তিনি প্রমাণ করেছেন, স্বৈরাচার, দালালদের চরিত্র পরিবর্তন হয় না। এর জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, রাঙ্গা যেকথা বলেছেন, এটা কোনো সুস্থ মানুষ বলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু সর্ম্পকে কথা বলার আগে তার চিন্তা করা দরকার ছিল। রাঙ্গার এই বক্তব্য গণতন্ত্রের ওপর আঘাত করেছে। তাকে শুধু ক্ষমা চাইলেই হবে না, জাতীয় পার্টিতে তার এই বক্তব্যের ক্লারিফিকেশন দিতে হবে।
তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, মনে হয় রাঙ্গা শুধু নূর হোসেনের বিরুদ্ধে নয়, দেশের স্বাধীনতা, সংসদ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রের ধারাকে অপমান করেছেন। তার এই বক্তব্যের জন্য যদি জাতীয় পার্টি কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে জাতীয় পার্টি আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। রাঙ্গাকে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি ক্ষমা না চাইলে জাতীয় পার্টি থেকে তাকে বহিষ্কার করতে হবে।
এসময় আরও বক্তব্য রাখেন- জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ, মুজিবুল হক চুন্নু প্রমুখ। তারাও রাঙ্গার ওই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ এবং সংসদে নিঃশর্ত ক্ষমার চাওয়ার দাবি জানান।
গত ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা নূর হোসেনকে ইয়াবাখোর বলে কটূক্তি করাসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও কটূক্তি করেন।