November 24, 2024
জাতীয়লেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগ’ পেয়েছে র‌্যাব

সম্প্রতি নিখোঁজ তরুণদের সন্ধানে গিয়ে যে নতুন জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ মিলেছে, তার সঙ্গে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যোগাযোগের তথ্য পাওয়ার দাবি করেছে র‌্যাব।

জঙ্গিবাদে দীক্ষা দেওয়ার অভিযোগে কুমিল্লার এক ইমামসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর সোমবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে এসে র‌্যাব কর্মকর্তারা বলেন, ‘জঙ্গিবাদে’ জড়িয়ে গত দুই বছরে বাড়ি ছাড়া ৫৫ তরুণের খোঁজ পেয়েছেন তারা।

তাদের মধ্যে ৩৮ জনের একটি তালিকা সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করে র‌্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, “আমরা যাদেরকে আটক করেছি, তাদের তথ্য মতে, এই ৩৮ জন পার্বত্য অঞ্চলে থাকার কথা এখন পর্যন্ত।”

দেশে এর আগে ইসলামী জঙ্গিবাদের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে পার্বত্যাঞ্চল কখনও সেভাবে আলোচনায় আসেনি।

পাহাড়ে কারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে- জানতে চাইলে আল মঈন বলেন, “পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী যে কোনো একটি বা দুটি সংগঠনের ছত্রছায়ায় তারা সেখানে অবস্থান করছে।”

তবে পাহাড়ি সংগঠনের নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে তিনি বলেন, “পার্বত্য কয়েকটি সংগঠনের নাম পেয়েছি, তবে তাদের নাম এখনই প্রকাশ করছি না।”

দেশের উগ্রবাদী তৎপরতা নিয়ে খোঁজ-খবর রাখেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন।

জঙ্গিদের সঙ্গে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার সন্দেহ, এসব বিষয় একই সূত্র থেকে উৎসরিত, তবে এগুলোর তথ্য নানা ফর্মে আমাদের সামনে আসছে।”

র‌্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী, নতুন এই জঙ্গি দলটি ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে সংগঠিত হচ্ছে। ভেঙে পড়া জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী ও (হুজি) আনসার আল ইসলামের দলছুট একদল নতুন দল গঠনের চেষ্টায় রয়েছে।

র‌্যাব মুখপাত্র আল মঈন বলেন, “আমরা জেনেছি এই সংগঠন পার্বত্য অঞ্চলে কিছু বিচ্ছিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের বিস্তারিত এখনও জানা যায়নি।”

তাদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে- সে প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত আমরা যাদেরকে পেয়েছি, তাদেরকে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের ৫০ জনের অধিক সদস্য দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে প্রশিক্ষণ নিয়েছে ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে।”

কুমিল্লার কোবা মসজিদের ইমাম শাহ হাবিবুল্লাহসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার হওয়ায় র‌্যাবের বলা এই সংগঠনের মোট ১২ জন ধরা পড়লেন চার দিনের ব্যবধানে।

র‌্যাব বলছে, হাবিবুল্লাহ (৩২) দুই বছর আগে নেয়ামতউল্লাহর মাধ্যমে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্য হন। তখন থেকেই তিনি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন মাদ্রাসা বা উন্নয়ন কাজের নামে টাকা তুলে সংগঠনের পেছনে ঢালতেন তিনি।

তারা কোনো নাশকতার পরিকল্পনা এঁটেছে কি না- জানতে চাইলে আল মঈন বলেন, “এরকম তথ্য দেওয়ার মতো এটা খুবই আরলি স্টেজ।

“তারা নতুন যে জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ গঠন করেছে, তার ব্যানারেই তারা পার্বত্য এলাকায় অবস্থান করছে। তাদের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজনকে আটক যদি করতে পারি, তাহলে তাদের পরিকল্পনার বিষয়ে অনেক তথ্যই পাব।”

এই দলটির বিষয়ে সরকারি অন্য সংস্থাগুলোকেও জানিয়েছে র‌্যাব।

“তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রাথমিক তথ্য আমরা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়েছি। বিভিন্ন বাহিনী আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে, তাদেরকেও এই তথ্য দিয়েছি। বর্তমানে সমন্বিতভাবে এই অভিযান চলছে।”

হাবিবুল্লাহর সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষক নেয়ামত উল্লাহকে (৪৩) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন ইলেকট্রিক ও রং মিস্ত্রী মোহাম্মদ হোসাইন (২২), কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী রাকিব হাসনাত ওরফে নিলয় (২৮) এবং রাজমিস্ত্রী সাইফুল ইসলাম ওরফে জায়দ চৌধুরী ওরফে রনি (১৯)।

এর আগে গত বুধবার রাতে একই সংগঠনের আরও সাতজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় র‌্যাব। ওই সাতজনের মধ্যে দুজন কুমিল্লা থেকে গত ২৩ আগস্ট নিখোঁজ হয়েছিলেন। কোবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহ তাদের জঙ্গিবাদে প্ররোচিত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ধাপে ধাপে নিরুদ্দেশ

র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, আনসার আল ইসলামের কাজের ধরন যে রকম ছিল, নতুন সংগঠনটিও তেমনি ‘টার্গেট বেসিসে’ দলে সদস্য ভেড়াচ্ছে।

“গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে আমরা তাদের যে মানহায বা কর্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তারা কোন ধরনের তরুণদের টার্গেট করে রিক্রুট করেছে, এই ধরনের তথ্য জেনেছি।”

তিনি বলেন, “আমাদের মনে হয়েছে, এতগুলো লোক ধাপে ধাপে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। অনেক পরিবার আছে যাদের সন্তান দুই বছর ধরে নিরুদ্দেশ, কিন্তু আমাদের কখনো জানায়নি। আমরা যখন তাদের কাছে যাচ্ছি, এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলছি তখন অনেকে বলছে হয়ত তারা বিদেশে।

“আবার যারা দুই-তিন মাস নিখোঁজ, তাদের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে হয়তবা চিল্লায় (তাবলিগ জামাতের) গেছে। একজন বাবা-মা যখন বলে যে তাদের সন্তান বিদেশে আছে তখন তো আমাদের বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে ভিন্ন বিষয় জানা যায়।”

 

র‌্যাবের মুখপাত্র আল মঈন বলেন, নিরুদ্দেশ তরুণদের কাছ থেকে পরিবারের কাছে টাকা আসার তথ্যও পেয়েছেন তারা।

“আমাদের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের সদস্যরা যখন এইসব তথ্য যাচাই করার জন্য তাদের পরিবারের কাছে গিয়েছে, তখন অনেক পরিবার বলেছে তাদের সন্তান বিদেশে রয়েছে বলে তারা জানেন। তারা এটাও বলেন যে, যখন তাদের টাকার প্রয়াজন হয়েছে, তখন তারা সন্তানের কাছ থেকে মাঝে মাঝে তা পেয়েছেন, যদিও সেটা খুব বেশি অর্থ নয়।

“তবে আমরা যাদের আটক করেছি তারা বলেছে, ওই ব্যক্তি বিদেশে নয় সংগঠনের কাজে পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে। মাঝে মাঝে সংগঠনের তহবিল থেকে পরিবারগুলোকে টাকা দেওয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, “নতুন যে জঙ্গি সংগঠনটি তারা নিজেদের আগের জঙ্গি সংগঠনগুলোর চেয়ে শক্তিশালী বলে দাবি করে। তাদের কর্মপ্রক্রিয়ার মধ্যেই রযেছে যখন কোনো সদস্যের পরিবার বিপদে পড়ে, তখন তাদের পাশে দাঁড়ায় তারা। তারা বলে, সংগঠনের কেউ আহত হলে বা অসুস্থ হলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা হবে। দ্বিতীয়ত পরিবারের কোনো সমস্যা হলে তারা সবার আগে সেটা সমাধানের চেষ্টা করবে। এরকম বিভিন্ন কথা বলেই তারা এদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে।”

নতুন সংগঠনের এত তহবিল কোথা থেকে আসছে- জানতে চাইলে র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “তাদের বিষয়ে বিস্তারিত অনেক কিছুই এখনও জানা যায়নি। কারণ যারা ধরা পড়েছে এরা আঞ্চলিক সমন্বয়ক। তারা নিজেরা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে চাঁদা তুলে সেই টাকা সংগঠনে ঢেলেছেন। এছাড়া তাদের কিছু সমর্থক বা সহমর্মীর কাছ থেকেও টাকা পেয়েছেন বলে জেনেছি।

“বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসা বা উন্নয়নমূলক কাজের জন্য চাঁদা তুলে সংগঠনে ঢালছে তারা। সংগঠনের কর্মপ্রক্রিয়ায় বলা হয়েছে, যারা মাসে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে পারবে এরকম সদস্যদের সংগঠনে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।”

গত দুই বছরের মধ্যে ঘর ছেড়ে নিখোঁজ হয়ে উগ্রবাদে জড়িয়েছেন এরকম সন্দেহভাজন ৫৫ জনের নাম পেলেও যাচাই করে বিভিন্ন জেলার ৩৮ জনকে শনাক্ত করতে পারার কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

বাকি আরও কয়েকজনের নাম যাচাই করা যায়নি, সেগুলো তাদের সাংগঠনিক নাম হয়ে থাকতে পারে বলে র‌্যাব কর্মকর্তাদের ধারণা।

তারা বলছেন, জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোতে নিজেদের পরিচয় ঢাকতে তারা একেক জায়গায় একেকটি নাম ব্যবহার করে থাকে। তবে এই এই ৫৫ জন বা ৩৮ জনের তালিকায় সংগঠনের কোনো বড় নেতা নেই।

কেন এই তালিকা প্রকাশ, তার ব্যাখ্যায় আল মঈন বলেন, “আপনি যদি হলি আর্টিজানের প্রেক্ষাপটটা দেখেন… এরা যদি হিজরতের জন্য বের হয়ে যায়। এজন্য এটা আমরা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি।

“আমরা আর আমাদের মধ্যে কোন কিছু রাখছি না। সকল স্টেকের সহায়তা পেলে আমরা এদের আইনের আওতায় আনতে পারব।”

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *