দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছেন যারা
ফুটবল গোলের খেলা। গোল করা ও করানোতেই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই খেলাটির মাহাত্ম্য। এ কারণে যারা গোল করেন, তারাই থাকেন পাদপ্রদীপের আলোয়। আবার যারা পেছনে থেকে প্রতিপক্ষের আক্রমণ নস্যাৎ করে দেন, তারাও পান স্পটলাইট। আর গোলরক্ষকদের ক্ষেত্রে? বেরসিকের মতো গোল আটকে দেওয়া যেহেতু তাদের কাজ, সেহেতু তাদের নিয়ে মাতামাতি তুলনামূলক কম।
কিন্তু গোলরক্ষকের নৈপুণ্য ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছে, এমন নজির তো কম নয়! বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসেও তেমন উদাহরণের কমতি নেই। অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দারুণ সব পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে অনেকেই পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তিতে, পেয়েছেন অমরত্ব। বহু বছরের ব্যবধানে তাদের গল্প এখনও ঘোরাফেরা করে ফুটবলপ্রেমীদের মুখে মুখে।
গোলরক্ষকরা তারকাখ্যাতি না পেলেও তাদের ভূমিকাও ভীষণ গুরুত্ব বহন করে। ২০১০ বিশ্বকাপের দিকেই চোখ ফেরানো যাক! দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বসেছিল ফুটবলের মহাযজ্ঞ। যা কিনা ছিল আফ্রিকা মহাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র বিশ্বকাপ। ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের আরিয়েন রোবেনের শট পা বাড়িয়ে আটকে দিয়েছিলেন গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াস। সেই অসাধারণ সেভ না করলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ আদৌ পেত কি স্পেন?
অথবা ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে আরও চার বছর পেছনে যাওয়া যাক। জার্মানিতে অনুষ্ঠিত আসরের শিরোপা নির্ধারণী মঞ্চে মুখোমুখি হয়েছিল ফ্রান্স ও ইতালি। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ফাইনালের ১০৩তম মিনিটে দ্বিতীয় গোল পেয়েই যেতে পারত ফরাসিরা। ডি-বক্সের ভেতরে ফাঁকায় থাকা জিনেদিন জিদান করেছিলেন জোরালো হেড। অতিমানবে রূপ নিয়ে দারুণ ক্ষিপ্রতায় তা রুখে দিয়েছিলেন ইতালিয়ান গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুফন। তিনি বীরত্ব না দেখালে ম্যাচটা হয়তো টাইব্রেকার পর্যন্ত যেত না। হয়তো জিদান অবসরে যেতেন আরেকটি শিরোপা উঁচিয়ে ধরে।
গোলরক্ষকদের ছোট একটি ভুল যেমন পাল্টে দেয় খেলার গতিপথ, মুহূর্তে এলোমেলো করে দেয় হিসাবনিকাশ, তেমনি উপরের উদাহরণগুলোর মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জরুরি অবদান পায় ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী আসন। আর বিশ্বমঞ্চে তাদের পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি দেওয়া হয় ‘গোল্ডেন গ্লোভ’ পুরস্কারের মাধ্যমে। বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষককে দেওয়া হয় এই সম্মাননা। ২০১০ বিশ্বকাপ থেকে ‘গোল্ডেন গ্লোভ’র প্রচলন হলেও ১৯৯৪ সালে এর যাত্রা শুরু। ২০০৬ সালের আসর পর্যন্ত পুরস্কারটির নাম ছিল ‘লেভ ইয়াশিন অ্যাওয়ার্ড’। কে এই ইয়াশিন?
ইয়াশিন ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র গোলরক্ষক, যিনি ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন। ১৯৬৩ সালে সেরাদের সেরা হওয়ার পর ১৯৬৬ বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেবার চতুর্থ স্থান পেয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর আগে ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালের আসরেও খেলেন ইয়াশিন। কালো জার্সি ও প্যান্ট পরে খেলায় তাকে ডাকা হতো ‘ব্ল্যাক স্পাইডার’ নামে। বিংশ শতাব্দির সেরা গোলরক্ষকের তকমাও তার গায়ে।
১৯৬৬ সালে সোভিয়েতরা সেমিফাইনালিস্ট হলেও ইয়াশিন নয়, আসরের সেরা গোলরক্ষক হয়েছিলেন গর্ডন ব্যাঙ্কস। সেবার ঘরের মাঠে শিরোপা জেতার উল্লাসে মাতোয়ারা হয়েছিল তার দল ইংল্যান্ড। সেই ব্যাঙ্কসই চার বছর পর উপহার দেন ‘সেভ অব দ্য সেঞ্চুরি’। হেড কওে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে ‘গোল’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন! কিন্তু ব্যাঙ্কস তো হারার আগে হেরে যাওয়ার পাত্র নন। চোখ ধাঁধানো কায়দায় নিশ্চিত গোল ঠেকিয়ে দেন তিনি। পরে বলেছিলেন, ‘আমাকে সবাই বিশ্বকাপ জেতার জন্য মনে রাখবে না, মনে রাখবে ওই সেভটির জন্য।’
ব্যাঙ্কসের চিরস্মরণীয় হওয়ার আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। ফাইনালে তারা হারিয়েছিল ইতালিকে। সেই ইতালিরই একজন স্পেনে অনুষ্ঠিত ১৯৮২ বিশ্বকাপে গড়েছিলেন অনবদ্য এক কীর্তি। চল্লিশ পেরিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে শিরোপা জিতিয়েছিলেন গোলরক্ষক দিনো জফ। সবচেয়ে বেশি বয়সে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড তার দখলে। ফাইনালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে যখন ইতালিয়ানরা বিশ্বজয়ের উৎসব করছে, তখন জফের বয়স ৪০ বছর চার মাস ১৩ দিন!
জফের আগে অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা গোলরক্ষক ছিলেন কেবল একজন। তিনিও ইতালির, নাম জিয়ানপিয়েরো কম্বি। ১৯৩৪ আসরে নিজেদের মাঠে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আজ্জুরিরা। জফের পর তালিকায় যুক্ত হয়েছেন আরও দুজন। ২০১০ সালে ক্যাসিয়াস ও ২০১৮ সালে হুগো লরিস যথাক্রমে স্পেন ও ফ্রান্সের শিরোপা জয়ে নেতৃত্ব দেন।
গোলপোস্ট অক্ষত রাখা যেহেতু গোলরক্ষকের কাজ, বিশ্বকাপে সেটা সবচেয়ে বেশিবার কে করেছেন? প্রশ্নটা হবে কে নয় কারা? কারণ, দুজনের নাম রয়েছে তালিকার শীর্ষে। একজন ফ্রান্সের ফাবিয়ান বার্থেজ, আরেকজন ইংল্যান্ডের পিটার শিলটন। তারা সমান ১০টি করে ম্যাচে কোনো গোল খাননি।
শিলটন যখন ১৯৯০ সালে নিজের শেষ বিশ্বকাপ খেলেন, তখন তার বয়স ছাড়িয়েছে ৪০। ইতালিতে হওয়া সেই আসরে নজর কাড়েন সার্জিও গয়কোচিয়া। এই গোলরক্ষকের দৃঢ়তায় মূলত ফাইনালে উঠেছিল আর্জেন্টিনা। মজার ব্যাপার হলো, তিনি কোচ কার্লোস বিলার্দোর প্রথম পছন্দ ছিলেন না। মূল গোলরক্ষক নেরি পম্পিদো বিশ্বকাপ চলাকালে চোটে পড়ায় সুযোগ মিলেছিল গয়কোচিয়া। বাকিটা যেন রূপকথার গল্প!
কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্লাভিয়া ও সেমিফাইনালে স্বাগতিক ইতালির বিপক্ষে দুটি পেনাল্টি শুটআউটে নায়ক বনে যান গয়কোচিয়া। ফাইনালেও আর্জেন্টাইনদের লক্ষ্য ছিল গোল হজম না করে লড়াই টাইব্রেকারে নেওয়া। কিন্তু সেবার তা পূরণ হয়নি। রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্তে পাওয়া পেনাল্টিতে গয়কোচিয়াকে পরাস্ত করেন আন্দ্রেয়াস ব্রেহমে। শিরোপা যায় পশ্চিম জার্মানির ঝুলিতে।
পূর্ব ও পশ্চিম, দুই জার্মানি আবার একীভূত হওয়ার পর দেশটি প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলে ২০০২ সালে। আরও দুটি ‘প্রথম’ ঘটনার সাক্ষী ছিল ওই আসর। এশিয়া মহাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে যৌথ আয়োজক ছিল জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। আর ইতিহাসের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে গোল্ডেন বল জিতেছিলেন অলিভার কান। আক্রমণাত্মক কৌশলের জন্য খ্যাত এই তারকা বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন জার্মানি রানার্সআপ হওয়া সত্ত্বেও!
‘প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র’, এই মানদণ্ড দিয়ে ইতি টানা যাক গোলরক্ষকদের গৌরবময় আখ্যানের। রেকর্ড পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের গত শতাব্দীর সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন গিলমার। তিনটি বিশ্বকাপে টানা অংশ নিয়েছিলেন তিনি। যার প্রথম দুটিতে জিতেছিলেন শিরোপা, ১৯৫৮ ও ১৯৬২ আসরের ফাইনালে। পরপর দুবার শুরুর একাদশে থেকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধুর অভিজ্ঞতা নেই আর কোনো গোলরক্ষকেরই!