তেলের দর: সৌদি-রাশিয়া টানাপড়েনে বিশ্ব বাজারে ধস
তেলের উৎপাদন কমানোর বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় ব্যর্থ হয়ে শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরবের তেলের দাম কমানোর পর বিশ্ববাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে।
জ্বালানি বাজারের চলমান অস্থিরতার মধ্যে সোমবার এশিয়ার শীর্ষ অপরিশোধিত তেল ব্রেন্টের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গিয়ে ব্যারেলপ্রতি ৩১ দশমিক ০২ ডলারে নেমেছে, যেটাকে ‘দর নিয়ে যুদ্ধের’ শুরু হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর শীর্ষ সংগঠন ওপেকের সঙ্গে মিত্র শক্তি রাশিয়ার দর যুদ্ধ শুরুর এই শঙ্কার ধাক্কা লেগেছে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এশিয়াসহ বিশ্ব পুঁজিবাজারেও।
প্রাণঘাতী এই ভাইরাস চীন থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার বড় আঘাত বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়ার শঙ্কার মধ্যে চীনের রপ্তানিতে ধস ও জাপানের মন্দা পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের এমনিতেই শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে।
তার মধ্যেই সোমবার লন্ডনে দিনের লেনদেনের শুরুতেই বাজারে দরপতন হয়- শীর্ষ সূচক এফটিএসই ১০০ আট শতাংশ পড়েছে।
এদিকে জাপানের পুঁজিবাজারের প্রধান সূচক নিক্কেই-২২৫ পাঁচ শতাংশের বেশি পড়েছে, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান সূচক এএসএক্স ২০০ পড়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন।চীনের প্রধান সূচক সাংহাই কম্পোজিট সূচকে দুই শতাংশের বেশি দরপতন হয়েছে, যেখানে হংকংয়ে হ্যাং সেং সূচক পড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অর্থনৈতিক ঘাত মোকাবেলায় জেরবার চীন শনিবার বছরের প্রথম দুই মাসের আমদানি ও রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাকে ৭১০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সময়ে দেশটির রপ্তানি আয় কমেছে ১৭ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে আমদানি কমেছে ৪ শতাংশ।
তেলের বাজারের প্রভাবে পাকিস্তানের প্রধান সূচক ৪৫ মিনিটে ২১০৬ পয়েন্ট পড়ে যাওয়ার লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে জিও টিভি।
বড় ধস দেখেছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারও। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এক দিনেই সাড়ে ৬ শতাংশ কমে গেছে।
‘তেলের দর নিয়ে যুদ্ধ’
তেলের উৎপাদন কমিয়ে আনার বিষয়ে আগেও ওপেক ও রাশিয়া একসঙ্গে কাজ করেছে। শেষ দফায় শুক্রবার সৌদি আরবের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের ওপেকের সঙ্গে রাশিয়াসহ নন-ওপেক মিত্রদের বৈঠকের পর থেকে তেলের দর হোঁচট খেয়েছে।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে তেলের চাহিদার পতনোন্মুখ প্রবণতার মধ্যে করণীয় নির্ধারণে আলোচনা হলেও দিনে অন্তত ১৫ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমানোর সৌদি আরবের প্রস্তাবে একমত হতে পারেনি দুই পক্ষ।
এর ফলে শুক্রবারই অপরিশোধিত তেল ব্রেন্টের দর ব্যারেলপ্রতি ৫০ ডলারের নিচে নেমে যায়। সপ্তাহান্তে সৌদি আরব তেলের দাম ব্যাপক হারে কমানোর পর সোমবার এশিয়া দরপতনের ধারায় রয়েছে। এ অঞ্চলের প্রধান তেল আমদানিকারকদের মধ্যে রয়েছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত।মর্গান স্ট্যানলির জ্বালানি বিশ্লেষক মার্টিন র্যাটস বলেন, এমনিতেই তেলের উৎপাদন চাহিদা ছাপিয়ে গেছে। এখন বাজার ধরে রাখার প্রতিযোগিতায় ওপেক দেশগুলো তেলের সরবরাহ আরও বাড়াবে বলেই আশা করা যাচ্ছে।
“উৎপাদন কমানোর পক্ষে ওপেক দেশগুলোর সামনে তেমন কোনো প্রণোদনা না থাকায় তেলের বাজারে সরবরাহ উপচে পড়ছে।”
সার্বিকভাবে তেলের দাম এই পর্যায়ে ছিল ২০১৬ সালে এবং এটা ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কাছাকাছি।
জ্বালানি বিশ্লেষক বন্দনা হরি বিবিসিকে বলেন, উৎপাদন কমানোর বিষয়ে ওপেক ও রাশিয়ার মধ্যে মতানৈক্যের প্রভাবে বাজারে এই ধাক্কা গত বছর সর্বোচ্চ উৎপাদক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ধাক্কাকে ছাপিয়ে গেছে।
“ওপেক-নন ওপেক দেশগুলোর মধ্যে জোটবন্ধন ভঙে তেলের বাজার বড় ধাক্কা খেয়েছে। এটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে আরও অনেক বাধা, যার ফলে সামনে কী অপেক্ষা করছে তার পুরো চিত্র দৃশ্যমান নয়।”
সোমবার তেলের দরপতনের পর পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে জ্বালানি কোম্পানিগুলো।
ইউরো স্টক্স ৫০ ফিউচার্সের ১০ শতাংশ দরপতন হয়েছে, যা কোম্পানিকে সবচেয়ে খারাপ দিনের রেকর্ডের নিয়ে যাচ্ছে।
শেয়ারবাজারে ও স্বাভাবিক বাজার ঘণ্টার বাইরের লেনদেনে দর নিয়ে বাজি ধরাকে ফিউচার্স বলে। বাজার খোলার পর কেমন যাবে তা বুঝতে এটাকে ব্যারোমিটার হিসেবে ব্যবহার করেন ব্যবসায়ীরা।