November 23, 2024
জাতীয়লেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

তীব্র শীতে নাকাল শিশুরা, হাসপাতালে বাড়ছে ভিড়

সাত মাস বয়সী শিশু সাদমান। জীবনে প্রথম শীত পার করছে রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের বেডে। নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ শীতজনিত সমস্যায় কয়েক দফায় মাসখানেকের ওপর হাসপাতালে ভর্তি আছে শিশুটি। সাদমানের মায়ের তথ্যমতে, কয়েক মাস ধরেই নিউমোনিয়া আক্রান্ত তার ছেলে। নিউমোনিয়া নিয়ে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর প্রথমবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। কিছুদিন ভর্তি থাকার পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও পুনরায় ২২ ডিসেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলে যান। তবে সম্প্রতি তীব্র শীতে তার সর্দি কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সাদমানের মতোই আরও অসংখ্য শিশু সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে। শিশু হাসপাতালের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরে হাসপাতালে নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছিল ৪৩৩ জন। আর চলতি জানুয়ারির ৮ তারিখের মধ্যে ১০২ জন শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছে। এছাড়াও বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছে ৫১ জন।

তেমনই একজন কুমিল্লা থেকে হাসপাতালটিতে আসা ১৪ মাস বয়সী রাজিব। শ্বাসকষ্টসহ নিউমোনিয়া নিয়ে তিন দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে শিশুটিকে। তার বাবা আমিনুল বলেন, ‘তীব্র শীতের কারণে বেশ কয়েক দিন যাবতই সর্দি-কাশিতে ভুগছিল রাজিব। এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে প্রথমে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা তার নিউমোনিয়া হয়েছে জানিয়ে শিশু হাসপাতালে রেফার করে।’

সিট পেতে বিড়ম্বনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে আসার পর নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে সিট পাইনি। রোগীর চাপ অনেক বেশি থাকায় সিট খালি নেই জানিয়ে প্রথম অন্য ওয়ার্ডে রাখা হয়। সেখান থেকে পরদিন এখানে পাঠানো হয়। তবে সেবার কোনো ঘাটতি ছিল না। ভর্তির দিন থেকেই চিকিৎসকরা নিয়মিত দেখছেন।’

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালটির প্রতিটি ওয়ার্ডই রোগীতে পরিপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ায় রোগীর চাপ সাধারণ সময়ের তুলনায় বহুলাংশে বেড়ে। এ অবস্থায় শিশুদের নিউমোনিয়া চিকিৎসায় আলাদা একটি ওয়ার্ড করেছে হাসপাতালটি। প্রতিষ্ঠানটির হাসপাতাল ভবনে সপ্তম তলার একটি বড় কক্ষকে ওয়ার্ডে রূপান্তর করা হয়েছে। গত নভেম্বর মাস থেকে সেখানেই শিশুদের নিউমোনিয়ার চিকিৎসা চলছে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, বিশেষ ওয়ার্ডটি চালুর পর থেকে কখনও কোনো বেড খালি থাকেনি। ফলে গত কয়েক দিনের তীব্র শীতে রোগী বাড়ায় স্থান সংঙ্কুলান নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। হাসপাতালে আসা রোগীদের ফেরত পাঠানো সম্ভব না হওয়ায় অন্যান্য ওয়ার্ডেও ভর্তি করতে হচ্ছে নিউমোনিয়া রোগীদের।

কয়েক দিনে তীব্র শীতের কারণে রোগী সংখ্যা অনেক বেড়েছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে টন্সিলাইটিস, ফেরেনজাইটিস, রাইনাইটিস, ব্রঙ্কোলাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি।
ডা. মো. কামরুজ্জামান, চিকিৎসক, শিশু হাসপাতাল
ওয়ার্ডে কর্মরত নার্সরা জানান, হাসপাতালের বিশেষ এই ওয়ার্ডটি মূলত শীতকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় ও নিউমোনিয়া রোগীদের জন্য চালু করা হয়েছে। শীত শুরুর পর থেকেই এখানে সারাদেশ থেকেই রোগী আসছে। এর মধ্যে কখনোই ওয়ার্ডে কোনো শয্যা খালি থাকেনি। একজন গেলে আরেকজন আসে। অনেক সময় সিট খালি না পাওয়া রোগীদের অন্যান্য ওয়ার্ডেও পাঠানো হয়।

কর্তব্যরত চিকিৎসক ও বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘কয়েক দিনে তীব্র শীতের কারণে রোগী সংখ্যা অনেক বেড়েছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে টন্সিলাইটিস, ফেরেনজাইটিস, রাইনাইটিস, ব্রঙ্কোলাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। সাধারণত শিশুরা এসব সমস্যা নিয়ে ভর্তি হলেও গত কয়েক দিনে সংখ্যাটি হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। হঠাৎ করেই শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এমনটা হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও তাপমাত্রা এতটা কম ছিল না। হঠাৎ করে পুরো দেশে তাপমাত্রা কমে যাওয়া, কুয়াশা বেড়ে গিয়ে সূর্যের আলো না আসসহ নানা কারণে শিশুরা ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে হাসপাতালেও রোগীর চাপ বেড়েছে।’

রোগীর চাপ বাড়ায় শয্যা সংকট দেখা দিলেও সেবায় কোনো ঘাটতি নেই উল্লেখ করে হাসপাতালে আসা সবাইকেই প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সারাদেশেই বেড়েছে শীতজনিত রোগ

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের মতো রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের হাসপাতালগুলোতেই শীতজনিত রোগে আক্রান্তদের চাপ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের জানিয়েছে, শীতের শুরু থেকেই বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এ ধরনের রোগীরা ভর্তি হচ্ছে। শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েছে শীতজনিত রোগ, বেড়েছে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও।

অধিদফতরের এমআইএস বিভাগের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী- গত ১৪ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত, সারাদেশে ৪৭ হাজার ৯৮২ জন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ জন মৃত্যুবরণ করেছে। শীতকালীন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে তিন লাখ ২৪ হাজার ৮১৮ জন। মারা গেছেন তিনজন।
বিভাগভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগে (মহানগর ব্যতীত) ১১ হাজার ৫৪ জন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া ময়মনসিংহে তিন হাজার ৪৭৮ জন, চট্টগ্রামে ১৭ হাজার ৭১৯ জন, রাজশাহীতে এক হাজার ৭৮৬ জন, রংপুরে এক হাজার ৩৭৮ জন, খুলনায় ছয় হাজার ৪৯৭ জন, বরিশালে তিন হাজার ২৭৬ জন এবং সিলেট বিভাগে দুই হাজার ৭৯৪ জন। আর এদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ ৪৯ জন মৃত্যুবরণ করেছে। এছাড়া ময়মনসিংহে ২০ জন, খুলনায় দুইজন ও বরিশালে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি বিভাগগুলোতে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।

ডায়রিয়ার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, এ সময়ের মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ দুই লাখ ২৮ হাজার ৩৪৩ জন আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে ১২ হাজার ৪৮৫ জন, চট্টগ্রামে ২৯ হাজার ৬৩৮ জন, রাজশাহীতে ১২ হাজার ৮৫১ জন, রংপুরে আট হাজার ১৫৭ জন, খুলনায় ১৬ হাজার ৩০৯ জন, বরিশালে ১০ হাজার ২৪৭ জন এবং সিলেট বিভাগে ছয় হাজার ৭৮৮ জন ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে ঢাকা মহানগরের দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২২ হাজার ৫২৮ জন। এর মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজার ৮৪৪ জন। এছাড়া শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৬৮৪ জন।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *