ঢাকার পুনরুজ্জীবনে ৫ রূপরেখা তাপসের ইশতেহারে
পুনরুজ্জীবিত ঢাকা গড়তে নির্বাচনী ইশতেহারে ঐতিহ্য সংরক্ষণ, সৌন্দর্য ও গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং সুশাসন ও সমন্বিত উন্নয়নের পাঁচ রূপরেখা হাজির করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস।
বুধবার সকালে রাজধানীর গুলিস্তানে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ছেলে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন।
তাপস বলেন, অনেক অবহেলা, গাফিলতিতে ঢাকা অপরিকল্পিত ও দূষণে আক্রান্ত নগরী হয়ে গেছে। এখন ‘ঐতিহ্যবাহী-সুন্দর-সচল-সুশাসিত-উন্নত ঢাকা’র পথে নতুন যাত্রা শুরু করতে হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে ঢাকাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন তিনি।
“দায়িত্বগ্রহণের ৯০ দিনের মধ্যেই মৌলিক সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবো ইনশাআল্লাহ্।”
ঐতিহ্যের ঢাকা
চারশ বছরের পুরনো এ নগরীরে ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তুলে ধরে নৌকার মেয়রপ্রার্থী বলেন, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ অনন্য; ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নানা উৎসবসহ রয়েছে স্বকীয় সাংস্কৃতিক ধারা।
পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকাকে ‘ঐতিহ্য প্রাঙ্গণ’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, সমন্বিত উদ্যোগে তিনি ‘যাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি নির্মাণ করবেন। মহাপরিকল্পনা ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করে ঢাকাকে তার স্বকীয় গৌরবে সাজিয়ে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরবেন।
সুন্দর ঢাকা
বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা দুই নদীর অববাহিকায় পত্তন হওয়া ‘বিরল শহর’ ঢাকার সৌন্দর্যবর্ধনের পরিকল্পনা তুলে ধরে তাপস বলেন, “ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকাটিকে সবুজায়ন, শিশুপার্ক, থিয়েটার হলসহ পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। র্দীঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পাড় ঘিরে বনায়ন, বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনসহ ব্যাপক সৌন্দর্য বর্ধনের মাধ্যেমে সুন্দর ঢাকা গড়ে তুলব।”
নগরীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উদ্যান নির্মাণ, সবুজায়ন, ছাদবাগানে উৎসাহ ও পরিবেশবান্ধব স্থাপনা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বায়ু ও শব্দ দূষণ রোধ করাসহ শরীর ও চিত্তবিনোদনের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ, শরীর চর্চাকেন্দ্র এবং নারী-শিশু ও প্রবীণদের জন্যে হাঁটার উন্মুক্ত স্থান, আধুনিক মানের কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থা করা হবে।”
সর্বসাধাণের সাধারণ ও ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের ব্যবস্থার পাশাপাশি দুঃস্থ-অসহায়দের কল্যাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও বস্তিবাসীদের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন তাপস।
এছাড়া রয়েছে অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও খনন করে জলাধার সংরক্ষণ, প্রয়োজনীয় সংখ্যক নর্দমা নির্মাণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও সড়কের উন্মুক্ত আবর্জনার স্তুপ প্রতিদিন অপসারণসহজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও।
সচল ঢাকা
তাপস বলেন, যানজটের কারণে রাস্তায় চলাচল হয়ে উঠেছে দুর্বিসহ। সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো ও ফিরে আসতে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়। বিশেষ করে কর্মজীবী নারীদের বিড়ম্বনা অপরিসীম।
“এজন্য গণপরিবহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিছু রাস্তায় দ্রুত গতির যানবাহন, কিছু রাস্তায় ধীর গতির যানবাহন, আবার কিছু রাস্তায় শুধু মানুষ হাঁটার ব্যবস্থা করব। দ্রুতগামী যানবাহনের জন্য থাকবে আলাদা পথ, থাকবে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা।”
নদীর পাড়ে থাকবে সুপ্রশস্ত রাস্তা, যেখানে পায়ে হেঁটে চলা যাবে, চালানো যাবে সাইকেল, চলবে রিকশা ও ঘোড়ার গাড়ি। রাস্তা পারাপারের সুব্যবস্থাসহ নগর ঘুরে দেখার জন্য থাকবে ‘হপ অন হপ অফ’ বাস সেবা।
জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় সড়ক বাতি রাখার পাশাপাশি সড়কের পাশে উন্নত ওয়াশ রুম নির্মাণ এবং হকারদের তথ্যভাণ্ডার করে তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ফুটপাত দখলমুক্ত করার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
সুশাসিত ঢাকা
সুশাসিত ঢাকা গড়ার পরিকল্পনা তুলে ধরে তাপস বলেন, মাদক নির্মূল, জুয়া, কিশোর অপরাধসহ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়জনিত বিভিন্ন অপরাধ রোধ করে এলাকাভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সংশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করবেন।
“ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন হবে বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম দুর্নীতি মুক্ত সংস্থা। বছরের ৩৬৫ দিন, সপ্তাহের ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য খোলা থাকবে।”
গৃহ কর না বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী বলেন, হতদরিদ্র সন্তানসন্ততির শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা; অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের শিক্ষা, বিনোদন ও চিকিৎসা সেবায় পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং স্থাপন করা হবে ডে-কেয়ার সেন্টার।
অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে প্রয়োজনে নিজস্ব দমকল বাহিনী গঠন ও ফায়ার হাইড্র্যান্ট নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পাড়া-মহল্লায় অগ্নি নির্বাপন গাড়ি প্রবেশের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
নগরীর উন্নয়নে একেক সময় বিভিন্ন সংস্থার সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করার পরিকল্পনা তুলে ধরে তাপস বলেন, বছরের একটি সময় নির্দিষ্ট করে ঢাকার উন্নয়ন ও সেবার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর কাছে ‘বার্ষিক কাজের চাহিদাপত্র’ চাওয়া হবে।
“কর্পোরেশন কোনো রাস্তা নির্মাণের পরে অন্তত তিন বছরের মধ্যে অন্য কোনো সংস্থা ওই রাস্তা খনন করতে পারবে না।”
সহজে ও দ্রুত নাগরিক সেবা দিতে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস ডেস্ক’ স্থাপনের কথা জানিয়ে নৌকার মেয়র প্রার্থী বলেন, সপ্তাহে একদিন নগরবাসী মেয়রের সাথে আলোচনার সুযোগ পাবেন।
উন্নত ঢাকা
আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর আলোকে উন্নত ঢাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন দলের মেয়র প্রার্থী তাপস।
তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ৩০ বছরমেয়াদী মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তার আওতায় পাঁচ বছরমেয়াদী নানা প্রকল্প হাতে নিয়ে ইমারত নির্মাণ, ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি অধিগ্রহণ ও নগরীর উন্নতিসাধন করা হবে।
নৌকার প্রার্থী বলেন, ঢাকা দক্ষিণে যুক্ত নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে ভালোভাবে প্রত্যেকটি সড়ক ও নর্দমার উন্নয়ন করা হবে, যাতে অন্তত ১০ বছর স্থায়িত্ব থাকে। জনসংখ্যার চাপ বিবেচনায় নিয়ে জমির যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার নিশ্চিত; জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য সুব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক হোস্টেল গড়ে তোলা হবে।সকল নাগরিক সেবাকে ডিজিটালাইজেশন করার পরিকল্পনা তুলে ধরে তাপস বলেন, বাণিজ্য লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধনপত্র, প্রত্যয়নপত্র, গৃহকর, পৌরকর, অন্যান্য কর সমূহ তথ্য প্রযুক্তিগত সেবার আওতায় আনা হবে। ঘরে বসেই কর এবং নির্ধারিত ক্ষেত্রে ফি পরিশোধ করা যাবে।
নাগরিক সেবায় ২৪ ঘণ্টা হেল্প লাইন, তথ্যসমৃদ্ধ নগর অ্যাপ, ই-লাইব্রেরি, নগর ভবনে নিয়ন্ত্রনকক্ষ রেখে বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ফ্রি ওয়াইফাই সেবা দেওয়ার কথাও জানান তাপস।
নিজের নির্বাচনী তরুণ প্রজন্মকে উৎসর্গ করে তিনি বলেন, “আমাদের ঢাকা, আমাদের ঐতিহ্য- এই স্লোগানে জনকল্যাণমুখী ও সুসমন্বিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে উন্নত ঢাকা হিসাবে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
“এই ঢাকা আমাদের সবার প্রাণের ঢাকা। আমি আশা করি, আগামী ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আমাকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে উন্নত ঢাকা গড়ে তুলতে সুযোগ দেবেন।”
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু এমপি, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন, ত্রাণ ও দুর্যোগ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আব্দুস সবুর, উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, কেন্দ্রীয় সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, কামরুল ইসলাম এমপি, রিয়াজুল কবির কাউসার, গোলাম রাব্বানী চিনু, আনোয়ার হোসেন, পারভীন জামান কল্পনা, সাহাবউদ্দিন ফরাজী, ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ও যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ এসময় তার সঙ্গে ছিলেন।