ডলার সংকটে বিপাকে বিদেশগামী শিক্ষার্থীরা
চলতি মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার অফার লেটার পেয়েছেন রাজধানীর আরিফুল আকরাম। এজন্য তিনি স্টুডেন্ট ফাইল ওপেন করতে কয়েকটি বেসরকারি ও সরকারি ব্যাংকে টানা এক সপ্তাহ ছোটাছুটি করেছেন। কিন্তু স্টুডেন্ট ফাইল ওপেন করতে পারেননি, যেটাকে ব্যাংকের ভাষায় বিদেশে পড়তে ইচ্ছুক ছাত্রদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বলা হয়। শেষমেষ তার বাবার পরিচিত ঊর্ধ্বতন এক ব্যাংক কর্মকর্তার মাধ্যমে বহু কষ্টে তা করতে পেরেছেন।
আরিফুল আকরামের বাবা ওয়াসিম আকরাম ঢাকা মেইলকে বলেন, সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, উরি ব্যাংকে যোগাযোগ করলে তারা জানান, আপাতত স্টুডেন্ট ফাইল ওপেন করা বন্ধ।
অন্যদিকে গেল ১১ নভেম্বরে ভারতের তামিলনাড়ুর ন্যাশনাল আইটি টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি পড়ার জন্য গিয়েছেন দিলরুবা হোসেন দিনা। যাওয়ার আগে এক হাজার ডলার এনডোর্স করতে রূপালী ব্যাংকের একটি শাখায় গেলে তারা সাফ না বলে দেন। এমনকি এটাও জানান, স্টুডেন্ট একাউন্ট খোলা আপাতত বন্ধ। অবশ্য পরে অনেক কষ্টে ৭০০ ডলার পেয়েছিলেন তিনি। সেটা নিয়েই উড়াল দেন ভারতে।
তার ভাই মুসাহিদ জানান সেই ভোগান্তির কথা। তিনি বলেন, আমরা বেশ কয়েকটি ব্যাংক ঘুরেছি কিন্তু কোনোভাবেই ডলার পাচ্ছিলাম না। রূপালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সাথে এক বড় ভাইয়ের পরিচয় ছিল। শেষমেষ সেই সূত্র ধরে আমরা ৭০০ ডলার পেয়েছিলাম। ৩০০ ডলার কম নিয়েই আমার বোনকে ভারতে পড়তে যেতে হয়েছে। এজন্য দিনাকে ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
১ হাজার চাইলে ৫০০ ডলার দিচ্ছে এমনটাও নয়। শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য কোনো ডলার এনডোর্স করতে পারছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে একদিকে যেমন বেকারের সংখ্যা বাড়বে অন্যদিকে রেমিটেন্সের ওপর প্রভাব পড়বে।
আব্দুর রউফ, স্বত্বাধিকারী, কনসালটেন্সি ফার্ম ড্রিমল্যান্ড এডুকেশন
শুধু আরিফুল আকরাম ও দিলরুবা হোসেন দিনাই নয়, তাদের মতো বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা ডলার সংকটের কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন।
বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন পাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের যেসব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে স্থানীয় ব্যাংকে ডলারে একটি স্টুডেন্ট ফাইল বা অ্যাকাউন্ট খোলা। যার মাধ্যমে সে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি ও সেখানে নিজের থাকা-খাওয়ার খরচের অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বন্ধ রেখেছে দেশের ব্যাংকগুলো। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, স্টুডেন্ট ফাইল খোলার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি।
শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি ফার্মগুলো বলছে, এভাবে চলতে থাকলে দেশের শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।
তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর একটি সূত্র জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে সাময়িকভাবে স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা বন্ধ রাখা হয়েছে। যদিও এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হচ্ছেন না।
এ বিষয়ে জানতে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের ভাইস চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের সিইও মাশরুর আরেফিনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার খুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাব মেলেনি। অন্যদিকে ব্র্যাক ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সেলিম এফ আর হুসাইনকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ডলার এনডোর্স করার কাজটি ব্রাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, উরি ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংক করত। কিন্তু গত নভেম্বর থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হলে তার প্রভাব পড়তে শুরু করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বতনদের সাথে যোগাযোগ না থাকলে ডলার এনডোর্স অথবা স্টুডেন্ট একাউন্ট খোলা যাচ্ছে না।
আমাদের অনেক স্টুডেন্ট বিভিন্ন ব্যাংকে ডলার এনডোর্স করতো। সেই ব্যাংকগুলো এখন তা করছে না। ফলে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের প্রিমিয়ার ব্যাংকে সেই কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে প্রিমিয়ার ব্যাংক এই সেবা কতদিন দেবে সেটাও একটা প্রশ্ন।
রোকন, স্বত্বাধিকারী, কনসালটেন্সি ফার্ম এম্পল এডুকেশন
কনসালটেন্সি ফার্ম ড্রিমল্যান্ড এডুকেশনের মালিক আব্দুর রউফ ঢাকা মেইলকে বলেন, ১ হাজার চাইলে ৫০০ ডলার দিচ্ছে এমনটাও নয়। শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য কোনো ডলার এনডোর্স করতে পারছে না। তিনি আরো বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে একদিকে যেমন বেকারের সংখ্যা বাড়বে অন্যদিকে রেমিটেন্সের উপর প্রভাব পড়বে। প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতেও। অনেকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
কনসালটেন্সি ফার্ম এম্পল এডুকেশনের মালিক রোকন বলেন, আমাদের অনেক স্টুডেন্ট বিভিন্ন ব্যাংকে ডলার এনডোর্স করতো। সেই ব্যাংকগুলো এখন তা করছে না। ফলে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের প্রিমিয়ার ব্যাংকে সেই কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে প্রিমিয়ার ব্যাংক এই সেবা কতদিন দেবে সেটাও একটা প্রশ্ন।
বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রতিটি ব্যাংকে স্টুডেন্ট ফাইল খোলার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, যারা বিদেশে পড়তে যেতে চান তাদের ডলার এনডোর্স করার ক্ষেত্রে সবগুলো বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে। ফলে কেউ বিদেশে পড়তে যাবেন- এমন কথা জানালেই ব্যাংকগুলো সরাসরি না বলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মিডিয়া বিভাগের কর্মকর্তা মিসবাহুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, এরকম কোনো নির্দেশনা নেই। তবে প্রকৃত প্রয়োজনটা দেখতে বলা হয়েছে। অনেক সময় আজেবাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি দেখিয়ে অনেকে দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। এ কারণে বিষয়গুলো খুব সচেতনভাবে দেখতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এনডোর্স না করা বা স্টুডেন্ট একাউন্ট না খোলার ব্যাপারে কোনো কিছু বলা হয়নি। শুধুমাত্র সংযতভাবে ডলার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এটা আমরা সবখানেই বলেছি- আমাদের যে সম্পদ রয়েছে সেটা সতর্কভাবে ব্যবহার করতে হবে। কারণ আমাদের যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের বড় সংকট বা অভাব চলে আসতে পারে।