January 19, 2025
আন্তর্জাতিক

জোর করে নবজাতকের মরদেহ দাহ, ক্ষোভে ফুঁসছেন শ্রীলঙ্কার মুসলিমরা

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে গত ৯ ডিসেম্বর ২০ দিন বয়সী এক মুসলিম শিশুকে বাবা-মায়ের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও দাহ করার ঘটনায় শ্রীলঙ্কায় ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এমন ঘটনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শ্রীলঙ্কার নিন্দা জানিয়েছে। খবর বিবিসির।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এমনিতেই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের অভিযোগ, গোটাবায়া রাজাপাকসে সরকার মুসলিমদের ধর্মীয় স্পর্শকাতরতাকে ইচ্ছা করেই অবজ্ঞা করছে।

দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ১০৭ জন মুসলিমকে জোর করে দাহ করা হয়েছে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত সন্দেহে মৃত শিশুটিকে জোর করে দাহ করার ঘটনা মুসলিমদের ক্ষোভকে আরও উস্কে দিয়েছে।

কলম্বোর যে স্থানে শিশুটিকে দাহ করা হয়েছে সেখানে মুসলিমরা রোববার দলে দলে হাজির হয়ে দেয়ালে গেটে সাদা ফিতা ঝুলিয়ে দেন। পুরো শ্রীলঙ্কা জুড়েই বহু মুসলিম তাদের দরজা-জানালা-দেয়ালে সাদা ফিতা বেঁধে প্রতিবাদ করছে। ‘স্টপফোর্সডক্রিমেশন’ এই হ্যাশট্যাগে প্রতিবাদ চলছে সামাজিক মাধ্যমেও।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেও প্রবাসী শ্রীলঙ্কান মুসলিমরা বিক্ষোভ করেছেন। তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন অন্য দেশের মুসলিম এবং মানবাধিকার কর্মীরাও। চারজন ব্রিটিশ এমপি এক যৌথ বিবৃতিতে দাহ করার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারে শ্রীলঙ্কার ওপর চাপ দিতে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেছেন।

এছাড়া, ৫৭টি মুসলিম দেশের জোট ওআইসি গত সপ্তাহে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মত বিবৃতি জারী করে মুসলিমদের দাহ করার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।

কলম্বোর দরিদ্র মুসলমান দম্পতির সন্তানের মরদেহ জোর করে দাহ করার ঘটনায় শিশুটির কোভিড হয়েছিল কিনা সে বিতর্কের এখনও কোনো সুরাহা হয়নি। শিশুটির বাবা একজন অটোচালক, নাম মোহাম্মদ ফাহিম।

তিনি এবং তার স্ত্রী সাফিনা ছয় বছর চেষ্টার পর তার ছেলের জন্মকে ঘিরে পুরো পরিবার হাসি, আনন্দে ভরে ছিল। গত ৭ ডিসেম্বর বাচ্চাটি অসুস্থ হওয়ার পর দ্রুত তারা তাকে কলম্বোর একটি হাসপাতালে নিয়ে যান।

কোভিড শনাক্ত করতে চিকিৎসকরা সেই রাতেই তিনজনের শরীরে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করেন। ফাহিম এবং সাফিনা করোনাভাইরাস নেগেটিভ হিসেবে শনাক্ত হলেও তাদের বাচ্চা পজিটিভ বলে জানানো হয়। চিকিৎসকরা শিশুটিকে রেখে রাতেই জোর করে বাবা-মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

মোহাম্মদ ফাহিম বলেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রী কান্নাকাটি করেছি যেন আমাদের বাচ্চার পাশে থাকতে দেয়া হয়। তারা তা দেয়নি।’ পরদিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর শিশুটির বাবাকে ফোন করে জানানো হয় যে শিশুটি কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ফাহিম এখনও মানতে চান না যে তার বাচ্চার আসলেই কোভিড হয়েছিল। তার দাবি, তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই যেখানে নেগেটিভ সেখানে তাদের বাচ্চার কিভাবে কোভিড পজিটিভ হয়?

শুধু অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া সিদ্ধান্ত তিনি মানতে পারছেন না। কিন্তু শুধু সন্তানের মৃত্যুই নয়, যেভাবে জোর করে তাদের আপত্তি পায়ে ঠেলে ২০ দিনের বাচ্চাকে দাহ করা হয়েছে, তা নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ পুরো পরিবারটি। দেশে-বিদেশে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছে যে বাচ্চার মরদেহ নিতে বাবা-মা অস্বীকার করার পর দাহ করার এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

মোহাম্মদ ফাহিম বলছেন, হাসপাতালের কথা ‘ডাহা মিথ্যা’। তাকে ডেকে নিয়ে জোর করে কাগজে সই করার জন্য চাপ দেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, দাহ করার আগ মূহুর্তে তাকে ফোন করে ক্রিমেটোরিয়ামে আসতে বলা হয়। তিনি গিয়েছিলেন, কিন্তু ভেতরে ঢোকেননি।

তিনি বলেণ, ‘আমি কী করে দেখবো যে আমার ২০ দিনের বাচ্চাকে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন কষ্ট যেন আর কাউকে সহ্য করতে না হয়।’ এমন পরিস্থিতিতে ভয়ে মুসলিমরা এখন হাসপাতালেও যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না।

শ্রীলঙ্কায় মুসলিম সংগঠনগুলোর জোট ‘মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা’র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইলমি আহমেদ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের তোয়াক্কা না করে মুসলমানদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তা ‘এক কথায় বর্ণবাদ।’

তিনি বলেন, ‘২০ দিনের একটি বাচ্চার মরদেহ জোর করে দাহ করা সমস্ত অসভ্যতার সীমাকে ছাড়িয়ে গেছে।’ আহমেদ বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণে মারা গেলে দাহ হতে হবে এই ভয়ে শ্রীলঙ্কার মুসলিমরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। শুধু এই ভয়ে অনেক মুসলিম করোনার উপসর্গ দেখা দিলেও হাসপাতালে যাচ্ছে না। গোপন রাখছে অথবা পরিচিত চিকিৎসকদের কাছে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, প্রতিদিন তাদের সংগঠনের কাছে শত শত ফোন আসছে সাহায্য চেয়ে। তারা বুঝতে পারছেন না কি করবেন। গত এপ্রিলে করোনাভাইরাসে মৃতদের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দাহ করার সিদ্ধান্ত জারীর পর থেকেই দেশটির মুসলিম সংগঠনগুলো এবং মুসলিম রাজনীতিকরা সরকারের সাথে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য দেন-দরবার শুরু করেন। বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে, মৃতদেহ দাহ করা ইসলামের অনুশাসন বিরোধী এবং মুসলিমদের কাছে এটি কত স্পর্শকাতর একটি বিষয়।

কিন্তু সরকার এতে কানে দিচ্ছে না। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের কবর দেওয়া পুরোপুরি নিরাপদ বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন এবং ১৯০টি দেশে কবর দেয়া এবং দাহ করা এই দু’টি নিয়মই পালন করা হলেও শ্রীলঙ্কা সরকার এসব যুক্তি মানছে না।

ইলমি আহমেদ বলেন, ‘সরকার বারবার দোহাই দিচ্ছে টেকনিক্যাল কমিটির পরামর্শে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি, যিনি ওই কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি একজন জুডিশিয়াল মেডিকেল অফিসার, তিনি কোনো ভাইরোলজিস্ট নন।

আমরা সত্যিকারের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এই টেকনিক্যাল কমিটির পুনর্গঠন চেয়েছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নৈতিকতারও একটি বিষয় রয়েছে, কমিউনিটির কথা রয়েছে। কোন কথাই কানে তোলা হচ্ছে না।

ইলমি আহমেদ আরও বলেন, তারা সরকারকে এমন প্রস্তাবও দিয়েছেন যে কংক্রিটের কাসকেট বানিয়ে মৃতদের কবর দেওয়া হোক, যাতে ভূগর্ভস্থ পানিতে কোন সংক্রমণ না ছড়াতে পারে। কিন্তু তাও তারা শোনেনি।

বিশেষজ্ঞ কমিটির কথা উল্লেখ করে সরকার যুক্তি দিচ্ছে যে, শ্রীলঙ্কায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভূপৃষ্ঠের অনেক গভীরে নয়। ফলে, করোনা রোগীকে কবর দিলে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হয়ে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।

মুসলিমরা এখন পর্যন্ত আদালতে এ নিয়ে যত আবেদন করেছে,দেশটির সুপ্রিম কোর্ট তার সবগুলো খারিজ করে দিয়েছে। ইলমি আহমেদ বলেন, তাদের এখন ভয় সরকারের এই ‘একগুঁয়েমি আচরণের’ প্রভাব মুসলিম তরুণ-যুবকদের ওপর কীভাবে পড়ে তা নিয়ে।

মুসলিম তরুণরা দেখছে, তাদের বাবা-দাদা-চাচাদের কবর না দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা অবশ্যই খুশি নয়। এতে করে অনেকেই হয়ত কট্টরপন্থার দিকে ঝুঁকতে পারে।

মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কার এই ভাইস-প্রেসিডেন্ট বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে মুসলমানদেরও দাহ করার এই সিদ্ধান্তের সাথে শ্রীলঙ্কায় কট্টর বৌদ্ধ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানের সম্পর্ক রয়েছে।

তিনি বলেন, কট্টর বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা এখন রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। গত নির্বাচনের আগে এসব বৌদ্ধ নেতারা খোলাখুলি বলেছেন যে, শ্রীলঙ্কা একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র, সুতরাং সরকার হবে বৌদ্ধ সরকার।

তারা একটি অভিন্ন আইন করার কথা বলছেন। বিয়ে, সম্পত্তি, জন্ম-মৃত্যু নিয়ে মুসলিমদের নিজস্ব যে সব ধর্মীয় আইন-কানুন রয়েছে সেগুলো কেড়ে নিতে চায় তারা। তারা এক দেশ, এক আইন চায়। মুসলিমদের জোর করে দাহ করার এই নির্দেশও তারই অংশ।

শ্রীলঙ্কার সরকার এখন কোভিডে মৃত মুসলমানদের মরদেহ মালদ্বীপে নিয়ে কবর দেওয়ার চেষ্টা করছে এমন একটি খবর শ্রীলঙ্কান মুসলিমদের মধ্যে নতুন ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

বার্তা সংস্থার এএফপি জানিয়েছে, মালদ্বীপের সরকার শ্রীলঙ্কায় কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মুসলিমদের কবর দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে।

মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদ এক টুইট বার্তায় বলেছে, ‘প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম মোহাম্মদ সোলিহ ইসলামী ধর্মমতে শেষকৃত্যের বিষয়ে শ্রীলঙ্কাকে সহযোগিতা করা নিয়ে তার মন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করছেন।’ মালদ্বীপের এই মন্ত্রী বলেন, প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের অনুরোধে মালদ্বীপ সরকার এটি বিবেচনা করছে।

মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতা ইলমি আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, পাকিস্তান এবং মালয়েশিয়ায় মরদেহ নিয়ে কবর দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে কিছু মুসলিম অধিকার কর্মী এবং কয়েকটি মুসলিম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ শুরু করেছে।

তবে বিদেশে নিয়ে কবর দেওয়া নিয়ে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে টুইটারে কলম্বোর সাংবাদিক মুনযা মুশতাক লিখেছেন, ‘আমরা সংখ্যালঘু হতে পারি, কিন্ত আপনার মতই আমরাও এদেশের নাগরিক। সুতরাং দয়া করে আমাদের এদেশেই কবর দেওয়ার অনুমতি দিন।’

ইলমি আহমেদ বলছেন, বিদেশে মরদেহ নিয়ে সেসব দেশে কবর দেওয়ার বিষয়ে মুসলিমরা দ্বিধাবিভক্ত। শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যমন্ত্রী পবিত্র ওয়ান্নিয়ারাচ্চিসহ করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুসলিমদের মরদেহ দাহ করার বিষয়টি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এতে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে সরকারের আরেক মন্ত্রী কেহেলিয়া রামবুকওয়েলা বলছেন, মুসলিমদের প্রতি কোন বৈষম্য করা হচ্ছে না। তার যুক্তি, বৌদ্ধরাও তো অভিযোগ করতে পারে যে তারাও পুরোপুরি ধর্মমতে শেষকৃত্য করতে পারছে না। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক টুইট বার্তায় বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসে তার মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ডেকে উঁচু কোন জায়গা যেখানে পানির স্তর বেশ নীচে এমন জায়গায় কবর দেওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *