জাপার গৃহবিবাদের কতটা অবসান হলো?
জাতীয় পার্টির ভেতরে গত কিছুদিন ধরে যে বিরোধ চলছিল, তাতে একটি সমঝোতা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন দলটির নেতারা। কিন্তু সামনের বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে এই বিবাদ পুরোপুরিভাবে যাবে কি না, তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে।
দলের চেয়ারম্যান ও প্রধান পৃষ্ঠপোষকের বিরোধে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার- কাউন্সিল আহ্বান ইত্যাদি কারণে ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল দলটি। সেই প্রক্রিয়া আপাতত ঠেকানো গেছে বলে নেতারা আশা করছেন।
কী সমঝোতা হয়েছে?
জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সোমবার ব্যাংকক থেকে চিকিৎসা শেষে বাংলাদেশে আসেন। পরদিন মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখা করেন দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। সেখানেই নাশতার টেবিলে তাদের প্রায় ৪০ মিনিট ধরে বৈঠক হয়।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ’দুজনকেই কিছু লোকে ভুল বুঝিয়েছিল। কাদের ভাইকে যেমন কিছু লোকে কথা বলে ম্যাডামের কাছ থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল, তেমনি ম্যাডামের কাছেও দুই-একজনে নানান কথা বলে দূরত্ব বাড়িয়েছিল। এদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করতে পারলে কিছু লোক ফায়দা নিতে পারে। সেটা আমরা নিরসন করতে পেরেছি।’
‘আমরা দুজনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, জাতীয় পার্টির মধ্যে যেকোনো কনফ্লিট বা ভাঙন বা ভুল বোঝাবুঝিতে আমাদের সাংঘাতিক ক্ষতি হবে। কারণ নির্বাচনের একবছর আছে। এই সময় আমাদের এক জাতীয় পার্টি থাকতে হবে।’
ওই বৈঠকে জাতীয় পার্টির দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে সমঝোতা হয়েছে যে, জি এম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যদিকে রওশন এরশাদ দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদের পাশাপাশি সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসাবেই থাকবেন। নেতারা বলছেন মাঝে যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, এর ফলে তার অবসান হয়ে গেল।
জাতীয় পার্টিতে যে কাউন্সিল ডাকা হয়েছিল, সেটাও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
দলের যে নেতাকর্মীদের বহিষ্কার করা হয়েছিল বা বিভিন্ন সময়ে যারা দল থেকে চলে গিয়েছিলেন, তাদেরও দলে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হবে।
আমরা দুজনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, জাতীয় পার্টির মধ্যে যেকোনো কনফ্লিট বা ভাঙন বা ভুল বোঝাবুঝিতে আমাদের সাংঘাতিক ক্ষতি হবে। কারণ নির্বাচনের একবছর আছে। এই সময় আমাদের এক জাতীয় পার্টি থাকতে হবে।
কাজী ফিরোজ রশীদ, কো-চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
নেতারা জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টি পরিচালনা থেকে জিএম কাদেরকে বিরত রাখতে যে মামলা হয়েছে বা বিরোধী দলীয় নেতার পদ থেকে রওশন এরশাদকে সরিয়ে দিতে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে, তা তুলে নেওয়ার বিষয়েও দুই নেতা একমত হয়েছেন।
গৃহবিবাদ কতটা কাটবে?
জাতীয় পার্টির মধ্যে গৃহবিবাদ শুরু হয়েছিল গত আগস্ট মাস থেকেই। তখন দলের ভেতরে দুটি গ্রুপের নেতাদের বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে উঠে।
থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রওশন এরশাদ অনেকটা হঠাৎ করেই জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলন আহ্বান করেন।
অন্যদিকে রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করেন জিএম কাদের। সেই সঙ্গে রওশন এরশাদকে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দিতে স্পিকারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।
জিএম কাদেরের চেয়ারম্যান পদ নিয়ে রওশনপন্থীরা আদালতে একাধিক মামলা করলে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আদালত। যদিও পরবর্তী উচ্চ আদালত তা স্থগিত করেন।
জাতীয় পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জানিয়েছে, সামনের নির্বাচনের আগে একটি অংশ চাইছিল তারা বর্তমান মহাজোট থেকে বেরিয়ে আলাদা অথবা বিএনপির সাথে মিলে নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছিল। অন্যদিকে রওশন এরশাদপন্থী গ্রুপটি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকতে চায়। মূলত এনিয়ে দলে বিরোধের সূচনা হয়।
জাতীয় পার্টির একজন পর্যবেক্ষক এবং বাংলাদেশ জার্নালের সম্পাদক শাহজাহান সরদার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ’জাতীয় পার্টি দলটি যখন গঠন করা হয়েছিল, তখন আসলে বিভিন্ন দলের সুবিধাবাদীদের নিয়েই গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, এরশাদ সাহেবও বিভিন্ন সময় নিজের সুবিধার জন্য বিভিন্ন দিকে ঝুঁকেছেন।’
রওশন এরশাদ বিমানবন্দরে নেমে তার চিকিৎসায় সহায়তা করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে বিএনপি জোটে যাওয়ার যে কোনো সম্ভাবনা জাতীয় পার্টির নেই, সেই ঘোষণাও দিয়েছেন।
অন্যদিকে গত কয়েক মাসে জিএম কাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন যে, ‘দেশে রাজনীতি নেই, দেশে রাজনীতি করার পরিবেশে সীমিত হয়ে গেছে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’
প্রায় পাঁচ মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেন রওশন এরশাদ। ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শাহজাহান সরদার বলছেন, ’জাতীয় পার্টির ভেতরে আসলে রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে কোনো বিরোধ নাই। এখন তাদের যে দ্বন্দ্ব, সেটা আসলে ব্যক্তি স্বার্থের দ্বন্দ্ব। হয়তো জিএম কাদের সাহেব মনে করেছেন, বিএনপির সাথে অ্যালায়েন্স করলে পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিপরিষদে ভালো পদ পেতে পারেন। আবার রওশন এরশাদ হয়তো মনে করেছেন, আওয়ামী লীগের সাথে থাকলে তার সুবিধা হবে। ফলে দলের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গে, আবার অন্য একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে জোট করতে চায়। এ নিয়ে দলের দুটি অংশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে।
একটা দলে বহু চিন্তাধারার মানুষ থাকে। কিন্তু ফাইনালি একত্রেই চিন্তাভাবনা হয়। এটা নিয়েও আমরা বসবো। পার্টির উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও আসেনি।
রুহুল আমিন হাওলাদার, সাবেক মহাসচিব, জাতীয় পার্টি
শাহজাহান সরদার বলছেন, ’এই মিলন আসলে সত্যিকারের মিলন না। যখন নির্বাচন আরও কাছাকাছি আসবে, তখন হয়তো দুই লাইনের অবস্থান আরও পরিষ্কার হবে। সমস্যা হলো জাতীয় পার্টি আগে যা ছিল, এখন তার চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র হয়ে এসেছে। ফলে নির্বাচনে বেশি আসন পেতে হলে বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ- যে কারো সঙ্গে তাদের অ্যালায়েন্স করতে হবে। এককভাবে নির্বাচন করলে তাদের আসন অনেক সীমিত হয়ে যাবে।
এর আগে ২০১৯ সালে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর স্ত্রী রওশন এরশাদ ও ভাই জিএম কাদের দুজনেই নিজেকে দলটির চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য তাদের মধ্যে সমঝোতা হলে একজন চেয়ারম্যান, অন্যজন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
দলের নেতারা কী বলছেন?
জাতীয় পার্টির ভেতরে থাকা বিরোধের কথা স্বীকার করে নিয়েই শীর্ষ নেতারা বলছেন, তারা সেটি সমাধানে কাজ করছেন।
কিন্তু আপাতত সমাধান হয়েছে বলে মনে হলেও অনেক জটিলতা কীভাবে নিরসন করা হবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ দলের সব পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল মশিউর রহমান রাঙ্গাকে। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ’তারা দুই পক্ষই আশা করেছে সমস্যা মিটবে। যাদের বহিষ্কার করেছে, তাদের ফিরিয়ে নিলে সমস্যা অনেক মিটবে। কিন্তু সমস্যা হলো, উনার বিরুদ্ধে কথা বললে উনি (চেয়ারম্যান জিএম কাদের) ২০ ধারা প্রয়োগ করে অনেককে দল থেকে বের করে দিয়েছেন। সেটা তো গণতন্ত্রের রাজনীতি হয় না।’
যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদেরকে দলে ফিরিয়ে আনা হবে, এরকম সিদ্ধান্তের কথা জানালে তিনি বলছেন, ’ফিরিয়ে আনা হবে আর আনা হলো- এর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তাদের এখন কোন পদে আনা হবে? তাদের আগের পোস্টে তো অন্য লোক দেয়া হয়েছে। আমি যেমন মহাসচিব ছিলাম, আমি গেলে আমার পোস্ট কি হবে? এখন কেমন করে নেয়া হবে, জিএম কাদের নেবেন কি না-সেগুলো জানতে হবে।’
তিনি বলছেন, এসব প্রশ্নের সমাধান না হওয়ার পর্যন্ত সন্তোষজনক বলা যাবে না।
জাতীয় পার্টির নেতারা জানিয়েছেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরোধ নিরসনে সরকারি দলের একজন নেতা মধ্যস্থতা করেছেন। সেই মধ্যস্থতাতেই বিরোধী দলের নেতা করা না হলে সংসদ বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পরেও সরে আসে জাতীয় পার্টি। রওশন এরশাদও সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন।
জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত এবং দলের অন্যতম কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার বলছেন, শীতল সম্পর্কের বরফ সবে গলতে শুরু করেছে। তিনি বলছেন, ‘সবে ওনারা বসছেন তো, বরফ গলছে। একদিনে তো সব সমস্যা হয়নি, একদিনেও সব সমস্যা যাবে না। তবে বসছে যখন, সমস্যার সমাধান হবে, আমি আশাবাদী।’
‘কাদের সাহেব চেয়ারম্যান হিসাবে যেটা দেখেন, নেতা-কর্মীরা তো সেটা দেখেন না। কোথায় কাকে রাখতে হবে, কি করতে হবে- ম্যাডামের সাথে তিনি কথা বলেছেন, সময় দিতে হবে। একসময়ে তো সব সমস্যার সমাধান হয় না।’
যাদের বহিষ্কার করেছে, তাদের ফিরিয়ে নিলে সমস্যা অনেক মিটবে। কিন্তু সমস্যা হলো, উনার বিরুদ্ধে কথা বললে উনি (চেয়ারম্যান জিএম কাদের) ২০ ধারা প্রয়োগ করে অনেককে দল থেকে বের করে দিয়েছেন। সেটা তো গণতন্ত্রের রাজনীতি হয় না।
মশিউর রহমান রাঙ্গা, বহিষ্কৃত জাপা নেতা
সামনের বছর জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কোন জোটে যাবে, এ নিয়ে দলের ভেতরে বিরোধ রয়েছে। দলের একাধিক নেতা বলছেন, জাতীয় পার্টি যাতে সামনের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকে, সেজন্য ক্ষমতাসীন দলের চাপ রয়েছে। জাতীয় পার্টির ভেতরে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেখানেও তাদের ভূমিকা রয়েছে।
কিন্তু জাতীয় পার্টির আরেকটি অংশ নির্বাচনে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। এসব বিরোধের সমাধান কতটা হয়েছে?
জাতীয় পার্টি নেতা রুহুল আমিন হাওলাদার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘একটা দলে বহু চিন্তাধারার মানুষ থাকে। কিন্তু ফাইনালি একত্রেই চিন্তাভাবনা হয়। এটা নিয়েও আমরা বসবো। পার্টির উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনো আসেনি।’
আর কাজী ফিরোজ রশীদ বলছেন, ‘এ নিয়ে এতো আগে আলোচনার কিছু নেই। নির্বাচনের আগে সবার সাথে আলাপ আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। কোথায় গেলে জাতীয় পার্টির নিজের ভাবমূর্তি ঠিক থাকবে, দেশের মানুষের কল্যাণ হবে, সেটা চিন্তা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।’ সূত্র: বিবিসি