জম্মু ও কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীদের পরামর্শদান
মজিদ মকবুল
কাশ্মীরের মুন্ডজি গ্রামের ২৩ বছর বয়সী তুলাইব আজম সম্প্রতি সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অফ কাশ্মীর থেকে বায়োটেকনোলজিতে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। গত পাঁচ বছর ধরে, তিনি JKScientists (JKS) এর পরামর্শদাতাদের সাথে যোগাযোগ করছেন। এটি কাশ্মীরি তরুণ গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সাহায্য করে আসছে।
তারা তাকে ক্যারিয়ার পরিকল্পনায় দিকনির্দেশনা দিয়েছিল, এমনকি তাকে তার সিভি এবং উদ্দেশ্য বিবৃতির খসড়া তৈরিতে সহায়তা করেছিল। এ বছরের শুরুর দিকে, আজম সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি, হায়দ্রাবাদের একটি প্রকল্পে গবেষণা সহকারী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। “পরামর্শদাতারা নকল সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন, যা আমাকে সিসিএমবি-তে সত্যিকারের পরীক্ষায় মুখোমুখি হতে ভালভাবে প্রস্তুত করেছিল,” তিনি বললেন।
বছর দশেক আগে ২০১১ সালে, মোবারক হোসেন সৈয়দ (এখন ৩৯ বছর বয়স) JKS শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে JKS চার হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীকে পরামর্শ দিয়েছে এবং তাদের উচ্চশিক্ষা অর্জনে ও নির্বাচিত ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করতে সহায়তা করেছে। JKS এর বছরব্যাপী মেন্টরশিপ প্রোগ্রামগুলিতে রয়েছে শিক্ষার্থীদের গবেষণাগারে যোগদান করার পাশাপাশি স্নাতকদের জন্য গ্রীষ্মকালীন স্কুলে প্রবেশের জন্য সহায়তার উদ্যোগ। প্রধান পরামর্শদাতারা জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দা হলেও সারা দেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণার সুযোগে সাহায্য করেন।
সৈয়দ বলেন, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরসহ দুইশ’রও বেশি শিক্ষার্থী তাদের প্রোগ্রাম থেকে প্রতি বছর উপকৃত হয়। এখন পর্যন্ত তারা তহবিল সংগ্রহ থেকে দূরে থেকেছে, শুধুমাত্র ২০১৯ সালের আগস্ট মাসব্যাপী অবরোধের সময় এবং গত বছর কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় অভিভাবকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ছাত্রদের সাহায্য করা ছাড়া।
মহামারী স্কুল এবং কলেজগুলিকে অনলাইনে ঠেলে দেওয়ার পর থেকে এই গ্রুপের প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়েছে। JKS ও একটি ডিজিটাল, ওয়ান অন ওয়ান মেন্টরশিপ প্রোগ্রামের দিকে মনোনিবেশ করেছে।
উমর সেলিম ভাট, যিনি বর্তমানে পাঞ্জাবের মোহালিতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চে নিউরোসায়েন্সে পিএইচডি করছেন, তিনিও ২০১৮ সালে শুরু হওয়া JKS- এর স্প্রাউট মেন্টরশিপ প্রোগ্রামের অন্যতম সুবিধাভোগী। তিনি কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজিতে এমএসসি ছাত্র হিসেবে পড়ার সময় এখানে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি একজন পরামর্শদাতা এবং JKS- এর জার্নাল ক্লাবগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভাট বলেন, “আমি যখন কাশ্মীরের বাইরে পিএইচডি পদের সন্ধান করছিলাম তখন JKS-এ আমার নিজের পরামর্শদাতারা আমার প্রচেষ্টাকে আরও ভালোভাবে পরিচালিত করতে সাহায্য করেছিলেন।” তিনি মনে করেন জম্মু ও কাশ্মীরের তরুণ ও উচ্চাভিলাষী বিজ্ঞানীদের দক্ষতাকে তীক্ষ্ণ করার ক্ষেত্রে মেন্টরশিপ প্রোগ্রামের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
কাশ্মীরের বুদগাম জেলার ওয়াহাবপুরা এলাকা থেকে আসা JKS এর প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক সৈয়দ বলেন, JKS প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটানো, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত এবং কম উপস্থাপিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ বলেন, “আমরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই করে তাদের মেধার বিকাশ এবং লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়েছি।” এই বছরের শুরুর দিকে তিনি নিউরাল আইডেন্টিটি, কানেক্টিভিটি এবং ফাংশন নিয়ন্ত্রণকারী পদ্ধতি বিষয়ে তার বর্তমান গবেষণা প্রকল্পের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন কর্তৃক ক্যারিয়ার পুরস্কারে ভূষিত হন।
২০০৫ সালে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর করার পর সৈয়দ বেঙ্গালুরুতে ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস-এ জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ২০০৮ সালে, তিনি জার্মানির মুনস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাক্স প্লাঙ্ক ফেলোশিপের মাধ্যমে জীববিজ্ঞানে পিএইচডি করতে যান। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ করেন।
সৈয়দ সমাজের জন্য কিছু করার প্রচেষ্টা শুরু করেন ২০১১ সালে, যখন তিনি পিএইচডি শেষ করার কাছাকাছি পর্যায়ে ছিলেন। কাশ্মীরের সমমনা বন্ধু এবং তরুণ বিজ্ঞানীদের সাথে, তিনি একটি শিক্ষামূলক উদ্যোগ শুরু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তাই তারা কাশ্মীর, জম্মু ও লাদাখ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য কাশ্মীর সাইন্টিস্টস নামে একটি ফেসবুক পেজ শুরু করেন এবং পরে এর নামকরণ করা হয় JKScientists। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি অলাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিবন্ধিত, JKS এর সদস্য সংখ্যা ১১ হাজারের বেশি রয়েছে, যার মধ্যে ছাত্র, শিক্ষক, বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা রয়েছেন।
সৈয়দ লকডাউন থেকে শুরু করে কারফিউ এবং ইন্টারনেট শাটডাউন ইত্যাদি চ্যালেঞ্জগুলি বুঝতে পারেন, যা এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরকে মুখোমুখি হতে হয়। তিনি বলেন, “সীমিত অবকাঠামো এবং সম্পদের পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থাও পুরনো। প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিভাকে প্রচার করা হয় না। বেশিরভাগ শিক্ষক আলাদা করে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত প্রচেষ্টা নেন না।”
সৈয়দ বলেন, “শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করতে এবং নতুন ধারণা নিয়ে আসতে উৎসাহিত হয় না। ফলস্বরূপ, যখন তারা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে, তাদের একটি ডিগ্রি থাকে কিন্তু সঠিকভাবে এবং পেশাগতভাবে যোগাযোগ করার দক্ষতার অভাব থেকে যায়।”
সৈয়দ বলেন, জেকেএস নারী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, “আমরা নারীদের জন্য একটি সহায়তা গ্রুপ তৈরি করেছি এবং সম্প্রতি একটি অনুপ্রেরণামূলক নারী সিরিজ শুরু করেছি যেখানে সফল নারী উদ্যোক্তা এবং গবেষকরা তরুণদের সঙ্গে, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।”
২০১৯ সাল পর্যন্ত, JKS স্বেচ্ছাসেবকরা বছরে একবার স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের মেন্টরিং প্রয়োজন এমন শিক্ষার্থীদের পরিদর্শন করত। কিন্তু সে বছর আগস্টে লকডাউন, তারপরে ২০২০ সালে কোভিড -১৯ এর প্রাদুর্ভাব, JKS এর অফলাইন কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ করেছে। তবে তারা অনলাইন ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং, মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, লেকচার এবং সচেতনতা সেশন অব্যাহত রেখেছে – যার মধ্যে কিছু কাশ্মীরের স্থানীয় টিভি চ্যানেলেও প্রচারিত হয়। JKS সদস্যরা উপত্যকা জুড়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী দান এবং সরবরাহ করার জন্য তাদের সাধ্যমত কাজ করেছে।
সৈয়দ এবং JKS- এর পরামর্শদাতারা অদূর ভবিষ্যতে স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার আশা প্রকাশ করেন। “আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হল দূরবর্তী স্থান থেকে শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করা (যেখানে তারা এখনও ছাত্রকেন্দ্রিক কর্মসূচি করেনি) যাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এবং প্রচারের সুবিধার অভাব রয়েছে,” তিনি বলেন।
এই বছর, JKS জম্মু ও কাশ্মীরে একটি বেসরকারি সংস্থা হিসেবে নিজেদের নিবন্ধন করার পাশাপাশি আলোচনা, দক্ষতা বিকাশ এবং পরামর্শের জন্য কাশ্মীরে একটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত কেন্দ্র চালু করার পরিকল্পনা করেছে।
লেখক : একজন শ্রীনগর ভিত্তিক সাংবাদিক।
দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ জে এফ জয়