জঙ্গিবাদে জড়িয়ে বাড়িছাড়া ৫৫ তরুণ হুমকি: র্যাব
উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় ঘরছাড়া ১৯ জেলার নিরুদ্দেশ ৫৫ তরুণের তালিকা প্রকাশ করেছে র্যাব। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের নাম-পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের খুঁজে বের না করা পর্যন্ত এই নিখোঁজ তরুণরা হুমকিস্বরূপ বলে জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, আমরা যে ৫৫ জনের তালিকা দিয়েছি সেখান থেকে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দুটি ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ ১০ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, বাড়িছাড়া ৫৫ তরুণ একসঙ্গে থাকার কথা নয়, তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করার কথা। আমাদের অভিযান টের পেয়ে হয়তো তারা দুটি ক্যাম্প থেকে আত্মগোপনে চলে যায়। তাদের খুঁজে বের না করা পর্যন্ত হুমকি।
নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী দুই সদস্যসহ তিনজনকে মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) রাতে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এ বিষয়ে বুধবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লা থেকে বেশ কয়েকজন তরুণ উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার একটি দল তাদের মধ্যে চার তরুণকে উদ্ধার করে ডি-রেডিক্যালাইজড করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়। কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া এক তরুণ নিজে বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপর পাঁচ অভিযানে ২৯ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
নতুন তিন জঙ্গি গ্রেফতার
কমান্ডার মঈন বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে র্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১১ এর অভিযানে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী আব্দুল হাদি ওরফে সুমন ওরফে জন (৪০) ও আবু সাঈদ ওরফে শের মোহাম্মদ (৩২) ও দাওয়াতি কার্যক্রমে জড়িত মো. রনি মিয়াকে (২৯) গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় তিনটি উগ্রবাদী বই, নয়টি লিফলেট ও দুটি ব্যাগ।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান নামক এক তরুণ গত মার্চ মাসে নিরুদ্দেশ হন। তার পরিবার সংশ্লিষ্ট থানায় একটি জিডি করে। এরই মধ্যে প্রকাশিত নিরুদ্দেশ ৫৫ জনের তালিকায় আবু বক্করের নাম রয়েছে।
‘নিজ সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে প্রেরণের সঙ্গে জড়িত আবু বক্করের মা আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলিকে গত ৫ নভেম্বর উদ্ধার করে র্যাব। পরে পরিবারের সান্নিধ্যে চারদিন ধরে ডি-রেডিক্যালাইজেশন মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখা হয়। আম্বিয়া সুলতানা এমিলি একটি স্বনামধন্য এয়ার লাইন্সে চাকরি করতেন।’
শিক্ষকের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এমিলি ও তার ছেলে আবু বক্কর
র্যাব জানায়, গৃহশিক্ষক আল-আমিনের মাধ্যমে তিনি ও তার ছেলে আবু বক্কর ২০২১ সালের প্রথম দিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায় যোগ দেন। পরবর্তীসময়ে আবু বক্কর ওই ২০২১ সালের মার্চ মাসে আল-আমিনের নির্দেশনায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে বাড়ি থেকে বের হন। পরে তিনি আর বাড়ি ফিরে আসেননি। অন্যান্য প্রশিক্ষণ শেষে গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি আল-আমিনের নির্দেশনায় গ্রেফতার রনি পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য আবু বক্করকে বান্দরবানে দিয়ে আসেন।
র্যাব আরও জানায়, আবু বক্কর পাহাড়ে প্রশিক্ষণে যাওয়ার পর সন্তানের কোনো খোঁজ-খবর না পেয়ে এমিলি সন্তানের চিন্তায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকেন। পরবর্তীসময়ে র্যাব সদস্যরা তার সন্ধান পেলে সন্তানকে ফিরে পেতে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এসময় তার দেওয়া তথ্য মতে, র্যাব রনি সম্পর্কে জানতে পারে এবং রনিই তার ছেলে আবু বক্করকে বাসা থেকে নিয়ে যায়। পরে রনিকে খুঁজে বের করতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। পরে গত রাতে রনিকে গ্রেফতার করা হয়।
‘মসজিদ-মাদরাসার কথা বলে নতুন জঙ্গি সংগঠনের জন্য টাকা তুলে ৯ লাখ টাকা দেন আব্দুল হাদি’
গ্রেফতার আব্দুল হাদি ওরফে সুমন সম্পর্কে খন্দকার মঈন বলেন, তিনি সুনামগঞ্জের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি এক থেকে দেড় বছর আগে সংগঠনের শুরা সদস্য সৈয়দ মারুফ ওরফে মানিকের মাধ্যমে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। তিনি ছিলেন সংগঠনের ‘ক’ শ্রেণির অর্থদাতা। সুমন গত তিন মাস আগে সংগঠনের শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান রাকিবকে সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য নয় লাখ টাকা দেন। ইংল্যান্ডে অবস্থানরত তার দুই প্রবাসী ভাইয়ের কাছ থেকে বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসার সহায়তার কথা বলে ওই টাকা সংগ্রহ করেন।
‘এছাড়া তিনি প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা সংগঠনে চাঁদা দিতেন। সুমন দুই মাস আগে হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হন। অন্যান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে পাহাড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু পাহাড়ে র্যাবের অভিযান চলতে থাকায় তিনি চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে এসে রনির মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে হিজরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার একটি সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় ১০ দিন কারাভোগ করেছেন সুমন।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার মো. আবু সাঈদ ওরফে শের মোহাম্মদ অনলাইন শরীয়াহ গ্র্যাজুয়েশন ইনস্টিটিউট নামক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও তত্ত্বাবধানের কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। তিনি এক থেকে দেড় বছর আগে শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান রাকিবের মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়।
তিনি আরও বলেন, আবু সাঈদ ওরফে শের মোহাম্মদ ছিলেন সংগঠনের একজন ‘ক’ শ্রেণির অর্থদাতা। তিনি দুই মাস আগে রাকিবের কাছে সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য সাত লাখ টাকা দেন। এছাড়াও তিনি প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতেন। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে তার শরিয়াহ ইনস্টিটিউট, মসজিদ, মাদরাসা ও এতিমখানায় সহায়তার কথা বলে এই অর্থ সংগ্রহ করতেন।
তিনি এক মাস আগে পাহাড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। কিন্তু পাহাড়ে অভিযান চলমান থাকায় রনির মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশলে পার্বত্য অঞ্চলে যাওয়ার জন্য একত্রিত হয়। তার বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী একটি মামলা রয়েছে।
সেপ্টেম্বরে বান্দরবানে যান রনি মিয়া
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার রনি মিয়া স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। পরে তিনি নারায়ণগঞ্জে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা শুরু করেন। তিনি এক বছর আগে ছোটবেলার বন্ধু আল আমিন ওরফে আব্দুল্লাহ’র মাধ্যমে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। আল আমিনের নির্দেশে তিনি গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আবু বক্করকে বান্দরবানে পৌঁছে দেন।
তিনি বলেন, রনি সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম ও হিজরত সদস্যদের বান্দরবানসহ বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। পার্বত্য অঞ্চলে র্যাবের অভিযান চলমান থাকায় গ্রেফতার আব্দুল হাদি ও আবু সাঈদ পাহাড়ে যেতে না পারায় তারা বিভিন্ন কৌশলে পার্বত্য অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গ্রেফতার রনির শরণাপন্ন হয়ে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় একত্রিত হন।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব মুখপাত্র কমান্ডার মঈন বলেন, র্যাব যেখানে অভিযান পরিচালনা করেছে, তা অত্যন্ত দুর্গম এলাকা। পাহাড়ের সর্বোচ্চ গড় উচ্চতা প্রায় আড়াই হাজার ফিট। সেখানে অভিযান পরিচালনা করা এবং পাহাড়ে শান্তিপূর্ণভাবে যারা বসবাস করছে তাদের কোনো ক্ষতি যেন না হয় সেভাবে অভিযান পরিচালনা করা।
‘যারা বুঝে বা না বুঝে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাহাড়ে গেছে তারাও যেন অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এ কারণেই পাহাড়ে অভিযানে দেরি হচ্ছে। ঘরছাড়া ৫৫ তরুণ নিখোঁজ রয়েছে। তাদের খুঁজে বের না করা পর্যন্ত আমাদের জন্য অবশ্যই হুমকি।’
গত পাঁচটি অভিযানে তালিকাভুক্ত যে ২৯ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তারা বলেছে সবাই স্বেচ্ছায় সেখানে গেছে। নিখোঁজদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে।