চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের দায় কাউকে নিতেই হবে : হাই কোর্ট
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক প্রাণহানির পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদামগুলো না সরানোর মধ্যে চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড ঘটায় উষ্মা প্রকাশ করেছে আদালত। আদালত বলেছে, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত, এটাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না। এর দায় কাউকে না কাউকে নিতেই হবে।
ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত, ক্ষতিপূরণ ও নির্দেশনা চেয়ে করা তিনটি রিট আবেদন সোমবার শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হলে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে এ মন্তব্য আসে।
২০১০ সালে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির জন্য রাসায়নিকের কারখানা ও গুদামগুলোকে চিহ্নিত করে পুরান ঢাকা থেকে সেগুলো সরিয়ে নিতে সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি।
আদালত বলেছে, নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে যেসব সুপারিশ করেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে চকবাজারের এই দুর্ঘটনা হয়ত ঘটত না।
বিচারক বলেন, পুরান ঢাকার ওইসব এলাকার বাড়ির মালিকরা তাদের বাসা দুই-তিনগুণ বেশিতে গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেন। আর নিজেরা থাকেন গুলশান-বনানীতে। সিটি কর্পোরেশন এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। পরে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনায় মারা যায় সাধারণ মানুষ।
বিচারক বলেন, আমরা পত্রিকায় দেখেছি নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরে প্রধানমন্ত্রী দুটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন। আবার চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর পরই উনি তা মনিটরিং করেছেন। উনি অনেক করছেন, কিন্তু উনি একা তো এ দেশটা চালাতে পারবেন না। সবারই তো দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমাদের দেশের ইমেজ (ভাবমূর্তি) নষ্ট হয়ে যাবে।
পরে আদালত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুলাহ আল মাহমুদ বাশারের আবেদনে মঙ্গলবার দুপুর ২টায় অ্যাটর্নি জেনারেলের উপস্থিতিতে আবেদনগুলোর শুনানির সময় নির্ধারণ করে দেয় আদালত। রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন রুহুল কুদ্দুস কাজল, ইউনুস আলী আকন্দ, নূর মোহাম্মদ আজমী, খন্দকার মো. সায়েদুল কাউছার ও মো. রিয়াজউদ্দন।
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় রোববার হাই কোর্টে চারটি রিট আবেদন ও একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। এসব আবেদনে চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়ার পাশাপাশি পুরান ঢাকা থেকে কেমিকেলের গুদাম-কারখানা অপসারণ ও বাণিজ্যিকভাবে মজুদ করা গ্যাস সিলিন্ডার অপসারণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও ২০১০ সালের নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির দেওয়া ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে এসব আবেদনে।
নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটির করা ১৭ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন চেয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), ব্র্যাক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট রোববার একটি সম্পূরক আবেদন করে।
নির্দেশনা বাস্তবায়নে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠনেরও নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে ওই আবেদনে। একই সঙ্গে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় হতাহতের ঘটনায় পুরান ঢাকায় আর যেন রাসায়নিক ব্যবসার অনুমোদন দেওয়া না হয়, আবেদনে সে নিষেধাজ্ঞাও চাওয়া হয়েছে।
সম্পূরক আবেদনটির শুনানি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাই কোর্ট বেঞ্চে মঙ্গলবার হতে পারে বলে জানিয়েছেন বেলার আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, সম্পূরক রুল চাওয়ার পাশাপাশি আবাসিক ভবনে অনুমতি না থাকা সত্তে¡ও বিপজ্জনক রাসায়নিক ও বিস্ফোরক দ্রব্য সংরক্ষণ করা চিহ্নিত ৩৬০টি কারখানার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে আবেদনে।
তিনি জানান, নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটির ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গোডাউন বা কারখানা বসানোয় লাইসেন্স বা অনাপত্তিপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি কেন নিশ্চিত করা হবে না, মর্মে রুল চাওয়া হয়েছে।
এছাড়াও চকবাজার অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের পরিবারসহ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা করে অন্তর্র্বতীকালীন ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে আবেদনে।
এদিকে নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটির ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নুর মোহাম্মদ আলী ও খন্দকার মো. সায়েদুল কাউছার এবং জেড আই খান পান্না রোববার আলাদা দুটি আবেদন করেন।
এছাড়া কেমিকেলের গোডাউন ও কারখানা এবং ব্যবসার উদ্দেশ্যে মজুদ করা গ্যাস সিলিন্ডার অপসারণের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুল জারির আরজি জানিয়ে বংশালের বাসিন্দা মো. জাবেদ মিয়া আরেকটি রিট আবেদন করেন।
এছাড়া চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে আরেকটি রিট আবেদন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ।
নুর মোহাম্মদ আলী ও খন্দকার মো. সায়েদুল কাউছার, ইউনুছ আলী আকন্দ ও মো. জাবেদ মিয়ার করা তিনটি রিট বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চে শুনানি হচ্ছে।