চীনে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, কারণ কী?
চীনে সাইকোথেরাপির চাহিদা বাড়ছে বলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাংহাইয়ের বাসিন্দাদের কথা ধরা যাক, যারা কয়েক মাস ধরে লকডাউনের মধ্যদিয়ে গেছেন। এখন তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন, কিন্তু তারপরও ক্রমাগত কোভিড-১৯ এর জন্য পরীক্ষা করা হচ্ছে, পজিটিভ রিপোর্ট আসলে পাঠানো হচ্ছে আইসোলেশন সেন্টারে।
চীনের বেশিরভাগ জনগণই এ বছর কোনো না কোনোভাবে লকডাউনের সম্মুখীন হয়েছেন। যদি করোনাভাইরাস যথেষ্ট যন্ত্রণার কারণ নাও হয় এখন, তবে অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাদের। চীনের যুব-বেকারত্বের হার ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, যা রেকর্ড পরিমাণে সর্বোচ্চ। এ বছরের শেষের দিকে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সেন্সরশিপ, নজরদারি ও নিপীড়ন উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
চীনের সামষ্টিক মানসিক স্বাস্থ্য মহামারির আগের চেয়েও খারাপ হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাংহাইয়ে ২০০৯ সাল থেকে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। শুধু কোভিডের কারণে নয়। যে শহরে ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত হয়েছিল, উহানে আত্মহত্যা এক বছরের আগের একই সময়ের তুলনায় ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে ৭৯ শতাংশ বেশি ছিল (যখন শহরটি লকডাউনের অধীনে)। গত এপ্রিলে যখন সাংহাইয়ে লকডাউন চালু হয়, তখন বাসিন্দাদের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ বিষন্নতার ঝুঁকিতে রয়েছে। সেই মাসে চীনের শীর্ষস্থানীয় সার্চ ইঞ্জিন বায়েদু-তে ‘মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ’ চাওয়া ২৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে সাংহাইতে।
মাও যুগের পর থেকে চীন অনেক দূর এগিয়েছে, যখন মনোবিজ্ঞানকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিপ্লবী উদ্যোগের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সম্প্রতি কয়েক বছরে সরকার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য আইন পাস করেছে এবং এ সম্পর্কিত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। যেমন আরও বেশি লোকের চিকিৎসা করা যারা হতাশাগ্রস্ত এবং মানসিক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি।
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে সরকার নিজেই সমস্যার একটি বড় অংশ। শুধু যে লকডাউন ও নিপীড়ন উদ্বেগ হতাশার দিকে পরিচালিত করে তা নয়। পার্টির অনুগত, সামাজিকভাবে রক্ষণশীল নাগরিকদের ছাঁচে সাইকোথেরাপি ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে এর প্রয়োগও ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, ভিন্নমতাবলম্বীরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানসিক হাসপাতালে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০১৮ সালে ডং ইয়াওকিওং নামে এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গিয়ে মানসিক ক্লিনিকে আটকে রাখা হয়।
প্রায়শই রাষ্ট্রের কৌশল আরও সূক্ষ্ম হয়। ২০০৮ সালে সিচুয়ান প্রদেশে ভূমিকম্পের পর, থেরাপিস্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে অভিভাবকদের বোঝাতে, তাদের সন্তানদের ওপর ভেঙে পড়তে পারে এমন অবকাঠামো নির্মিত স্কুলগুলোর বিষয়ে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকতে। সামাজিক স্থিতিশীলতা উন্নীত করার প্রয়াসে, থেরাপিস্টদেরকে বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়া লোকেদের বোঝানোর জন্য নিযুক্তও করা হয়। স্কুলে গাইডেন্স কাউন্সেলররা বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেদের সমকামিতা থেকে দূরে রাখার জন্য পুরস্কার পেয়েছেন, যা পার্টির রক্ষণশীল মূল্যবোধের বাইরে।
পুলিশের একজন থেরাপিস্ট লি ঝ্যাংকে বলেন, ‘যদি আমি সতর্ক না হই, তাহলে আমি সহজেই তাদের নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র হয়ে উঠতে পারি’। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী ঝ্যাং চীনের সাইকোথেরাপির রাজনীতি নিয়ে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন।
বৈধভাবে থেরাপি দেওয়া একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত একজন মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করার জন্য প্রশংসাপত্রের প্রয়োজনীয়তা ন্যূনতম ছিল। চীন সেই সিস্টেমটি বাতিল করেছে। যদিও আশ্চর্যের কিছু নেই যে অনেক সাধারণ মানুষ থেরাপিস্টদের বিশ্বাস করেন না, বলছেন ঝ্যাং। এমনকি থেরাপিস্ট যারা সরকারি চাকরি করেন না তারাও ইতিবাচক প্রচারের জন্য চাপ অনুভব করেন। এছাড়া লকডাউনের সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি।
থেরাপিস্টরা এটিকে এক ধরণের গ্যাসলাইটিং (এক ধরনের মানসিক নির্যাতন) হিসাবে বর্ণনা করেন, যেখানে রাষ্ট্র ভুক্তভোগী নাগরিকদের তাদের নিজস্ব অনুভূতি সম্পর্কে সন্দেহ করার চেষ্টা করে।