চা শ্রমিকদের ধর্মঘট অব্যাহত: ১৩ বছরে মজুরি বেড়েছে মাত্র ৭২ টাকা
১৩ বছরের ব্যবধানে দেশে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৭ টাকা। প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ১২৬ টাকা। প্রতি হালি ডিমের দাম বেড়েছে ২৮-৩০ টাকা। সেখানে ১৩ বছরে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি বেড়েছে মাত্র ৭২ টাকা। চা পাতার বোঝা কাঁধে সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করেও জেলখানার একজন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির চেয়েও কম খাবার খান চা শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যরা। বাংলাদেশ জেল কোড অনুযায়ী একজন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির পেছনে শুধু খাদ্য খরচ বাবদ চাল/ভাত-২৯২ গ্রাম, আটা/রুটি-১১৭ গ্রাম, মাস/মাংস-৩৭ গ্রাম, সবজি-২৯২ গ্রাম, ডাল ২ বেলা-১৪৫ গ্রাম, মরিচ-২.৪০ গ্রাম, হলুদ-১.২০ গ্রাম, ধনিয়া-৫১ গ্রাম, লবণ-৩২ গ্রাম, জ্বালানি ও পানীয় মিলে প্রতিদিনের আর্থিক ব্যয় কম-বেশি ৬৫ টাকা। সেখানে একজন এ ক্যাটাগরির চা শ্রমিক প্রতিদিন ২৩ কেজি চা পাতা তুলতে পারলে তার সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা। বি ও সি ক্যাটাগরির শ্রমিকের মজুরি আরও কম। এই টাকাতেই চলে চার-পাঁচজনের ভরণ-পোষণ, সন্তানের লেখাপড়া, ইউটিলিটি বিলসহ অন্যান্য খরচ। জনপ্রতি দৈনিক বরাদ্দ ২৪-৩০ টাকা। স্বামী-স্ত্রী দুজনই কাজ করলে জনপ্রতি দৈনিক ভাগে পড়ে ৪৮-৬০ টাকা, যা একজন কয়েদির খাবার খরচের চেয়ে কম। এই আয় থেকে আবার মেটাতে হয় ইউনিয়নের চাঁদা ও অন্যান্য খরচ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে টিকতে না পেরে গত ১০ আগস্ট থেকে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে নেমেছেন সারা দেশের চা শ্রমিকরা। দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবি তাদের। চা শ্রমিকরা বলছেন, তাদের সপ্তাহে দুই টাকা কেজি দরে রেশনের চাল/আটা দেওয়া হলেও অন্যান্য সবকিছু বাইরে থেকেই কিনতে হয়। ২০২০ সালে তাদের মজুরি ১৮ টাকা বাড়িয়ে ১২০ টাকা করা হয়। এই দুই বছরে সবকিছুর দাম দেড়-দুই গুণ বেড়েছে।
মৌলভীবাজারের চা শ্রমিক মালতি গঞ্জু বলেন, বাবা-মা চা শ্রমিক ছিলেন। এখন তিনি এ কাজ করেন। দৈনিক মজুরি ১২০ টাকায় চলে ছয়জনের সংসার। একটি ঘরেই গাদাগাদি করে থাকেন সবাই। সঙ্গে একটি গরুও ওই ঘরে থাকে। দিনমজুর স্বামী মতিলাল কোথায়ও কাজ পেলে করেন, নয়তো বেকার থাকেন। বড় ছেলের বউ সন্তানসম্ভবা। তাকে ভালোমন্দ কিছুই খাওয়াতে পারি না। ছোট ছেলেটাকে টাকার অভাবে অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়াতে পারিনি।
জানা গেছে, চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর চুক্তি হওয়ার কথা প্রতি দুই বছর পর পর। স্বাধীনতার পর চা শ্রমিকদের সর্বোচ্চ দৈনিক মজুরি ছিল এক টাকা দুই আনা। ২০০৯ সালে হয় ৪৮ টাকা। ২০১৭ সালে হয় ১০২ টাকা এবং সবশেষ ২০২০ সালে হয় ১২০ টাকা। গত ১৩ বছরে মজুরি বেড়েছে ৭২ টাকা। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেণ পাল বলেন, আমাদের মূল দাবি দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করতে হবে। আমরা আর চলতে পারছি না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী, দুই বছর পর পর মজুরি বৃদ্ধি করার কথা থাকলেও মালিকরা চুক্তির আইন ভঙ্গ করছেন। চা শ্রমিকরা যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির জন্য আন্দোলন করছেন সেই চুক্তির মেয়াদ শুরু হয়েছে ১ জানুয়ারি ২০২১ থেকে। চুক্তির মেয়াদের প্রায় ২০ মাস অতিক্রান্ত হতে চলেছে অথচ এখনো চুক্তিই স্বাক্ষর হয়নি।
এদিকে সরকারি তথ্য অনুসারে, দেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৩ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ টাকা। চা শ্রমিকদের সর্বোচ্চ আয় মাসিক ৩ হাজার ৬০০ টাকা হিসেবে বার্ষিক আয় ৪৩ হাজার ২০০ টাকা।
তবে টি অ্যাসোসিয়েশন বলছে, চা শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবি করলেও তারা ৩০০ টাকার বেশি সুবিধা পান। দৈনিক নগদ মজুরি ছাড়াও থাকার জায়গা, ওভারটাইম, বার্ষিক ছুটি ভাতা, উৎসব ছুটি ভাতা, অসুস্থতাজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিল ভাতা, কাজে উপস্থিতি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিলের ওপর প্রশাসনিক ভাতা দেওয়া হয়।
দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান খেলাফত মজলিসের : আন্দোলনরত চা শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে খেলাফত মজলিস। গতকাল এক যুক্ত বিবৃতিতে সংগঠনের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, চা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১২০ টাকা দিয়ে বর্তমান বাজারে কোনোভাবেই জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়। দৈনিক মজুরি ন্যূনতম ৩০০ টাকা করার দাবি খুব বেশি নয়। কালক্ষেপণ না করে সরকারের মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের এ দাবি মেনে নেওয়া উচিত।
আন্দোলন চলছেই : আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী, টানা সপ্তম দিনের মতো গতকাল সিলেটের কোনো বাগানের শ্রমিকরা কাজে যোগ দেননি। দিনব্যাপী তারা কর্মবিরতি পালন করেছেন। তবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান জন্মাষ্টমীর কারণে অন্য দিনের মতো গতকাল তারা মানববন্ধন কিংবা সভা-সমাবেশ করেননি। আজ থেকে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে চা শ্রমিকরা অবস্থান কর্মসূচি পালন ও সমাবেশ করবেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা।
এভাবে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে গতকাল শ্রমিকরা চা বাগানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। উপজেলার ভাড়াউড়া চা বাগানে নাটমন্দিরের সামনে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। এ ছাড়া কাকিয়াছড়া চা বাগানের শ্রমিকরা দাবি আদায়ে বসে থাকেন বাগানের রাস্তায়। ভুরভুড়িয়া চা বাগানের শ্রমিরা বাগানের ভিতর বিভিন্ন রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাগছড়া চা বাগান আঞ্চলিক শাখার উদ্যোগে চা ছাত্র জনতার সমাবেশ ও মিছিল ও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, শনিবার আমরা চা বাগান অধ্যুষিত শহরগুলোতে বিক্ষোভ মিছিল করব। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।