চায়ের আড্ডায় বেরিয়ে এলো খুনের রহস্য!
ক্লুলেস একটি খুনের ঘটনা তদন্তে চলছে দায়িত্বরত কর্মকর্তার দৌড়ঝাঁপ। কোনোভাবেই রহস্যের কুলকিনারা করতে না পারা ওই পুলিশ কর্মকর্তা একদিন আদালত পাড়ার চায়ের দোকানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।
এসব দোকানের ক্রেতা সাধারণত উকিলদের মক্কেল সংশ্লিষ্ট।
জামিন বা মামলার তদবির করতে আসা মক্কেলরা এসব দোকানে বসে চা খান, সময় কাটাতে গল্প করেন। ভিড় কমতেই ওই চা দোকানিকে কথার ছলেই জিজ্ঞাসা করেন নির্ধারিত এলাকার কোনো খুনের বিষয়ে কখনো শুনেছে কি-না। প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা, তাও দোকানদার স্মৃতি হাতরে এক জামিনপ্রাপ্ত আসামির গল্পের কথা বলেন।
চা দোকানি যেই আসামির গল্প বলছিলেন, সেটিও তার জেলখানায় থাকাকালীন সময়ের অপর এক চোরের গল্প। ওই গল্পেরই সূত্র ধরে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো এগুতে থাকেন দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা। একসময় হিসেব দুয়ে-দুয়ে চার মিলে যায়, উদঘাটিত হয় একটি হত্যাকাণ্ডের রহস্য।
২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের লোহাগড়া থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলার (নম্বর-২২) রহস্য উদঘাটনের পর এমন তথ্যই জানায় তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। জানা যায়, প্রত্যন্ত গ্রামে পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডটির মূলহোতা মামলার বাদীরই আপন ভাই অর্থাৎ নিহতের চাচাত ভাই।
পিবিআই সূত্র জানায়, নড়াইলের লোহাগড়া থানার নোয়াগ্রামের আমিরুল ইসলাম টনিক ভাগ্যান্বেষণে দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। ভালো অর্থ উপার্জন করে দেশে ফিরে থিতু (স্থায়ী) হয়েছেন বাড়িতে। ব্যবসা করবেন বলে ১৮ লাখ টাকা দিয়ে একটি গাড়ি কিনেন।
ব্যবসার উন্নতি দেখে আরও একটি গাড়ি কেনার জন্য একদিন ১২ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে তুলেন। সেদিন রাতে পাকা বাড়িতে টনিক নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলেন। আচমকা হালকা শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। এর মধ্যেই ‘তুই এখানে কি করিস’ বলে কাউকে তাড়া করে বাইরে নিয়ে যান। আদতে জানালার গ্রীল কেটে চোর ঢুকেছিল। সেই চোরকেই তাড়া করেন টনিক। তবে কিছুক্ষণ পর টনিককে খুঁজে পাওয়া গেল কিছুটা দূরে। তিনি মাথায় মারাত্নক জখম নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন।
তখনই ব্যাটারিচালিত অটোরিশায় করে তাকে জেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে পাঠানো হয় খুলনায়। আহত টনিককে তার মা জিজ্ঞাসা করেন- ‘চোর তো মনে হয় চিনেছো, কে এমন সর্বনাশ করলো। ’ আহত টনিকের উল্টো জবাব-‘আগে ঘরে ফিরি। তারপর দেখ কি করি। ’ কিন্তু দীর্ঘ ১৮ দিন ডাক্তার-নার্সদের সব চেষ্টা বিফল করে টনিক মারা যান।
শোকসন্তপ্ত পরিবারের পক্ষে থানায় খুনের মামলা দায়ের করেন টনিকের চাচাতো ভাই লাবু শেখ। খুনি-চোররা সবাই অজ্ঞাত। প্রায় দুই বছর বিভিন্ন সংস্থা ঘুরে মামলার তদন্তভার যায় পিবিআইতে।
নড়াইলে পিবিআই’র কোনো কার্যালয় না থাকায় মামলার তদন্ত কার্যক্রম যশোর থেকেই পরিচালিত হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তার কাছে শুধু এতটুকুই তথ্য- চোর টনিকের পরিচিত হতে পারে, আর এ ভরসায় এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করেন তিনি।
কোনোভাবেই রহস্যের কুলকিনারা করতে না পারা তদন্তকারী কর্মকর্তা একদিন বিশ্রামের জন্য আদালত পাড়ার একটি চায়ের দোকানে বসেন। এসব দোকানের ক্রেতারা সাধারণত জামিন বা মামলার তদবিরের জন্য উকিলের কাছে আসেন। সময় পার করতে এখাসে চা পান করেন আর নিজেরা গল্প করেন। ভিড় কমলে তদন্ত কর্মকর্তা কী মনে করে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেন তিন বছর আগের লোহাগড়ার কোন খুনের বিষয়ে এখানে কোনো গল্প শুনেছেন কি-না।
দোকানদার স্মৃতি হাতরে বলার চেষ্টা করেন, কোনো এক মামলার আসামি আদালতে হাজিরা দিতে এসে মাঝে-মধ্যে তার দোকানে চা খেতেন। সেই আসামি একদিন সতীর্থ একজনকে কথাচ্ছলে বলেছিলেন তার জেলখানায় থাকাকালীন সেখানকার এক চোরের গল্প। সেই চোর চুরি করার সময় গৃহকর্তা তাকে চিনে ফেলায় হাতে থাকা দা দিয়ে কোপ মারে। কোপ খেয়েও তাকে তাড়া করে প্রায় ধরে ফেলেছিলেন। সে ভয় পেয়েছে-আর কখনও চুরি করবে না বলে ভেবেছে।
চা দোকানির গল্পকে পুঁজি করেই ছুটতে থাকেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জেলখানার জামিনপ্রাপ্ত চা দোকানে গল্প করা সেই ব্যক্তিকে পাওয়া যায়। তার বাড়ি অন্যত্র হলেও আনা হয় যশোরে, সে কোনোভাবেই টনিকের খুনের সঙ্গে জড়িত নয়। তবে জেল কর্মীদের সাহায্য নিয়ে শনাক্ত করা হয় তার গল্পের সেই চোরকে। সে অন্য একটি মামলায় জেলে আছেন এবং নাবালক। তদন্তকারী দল আবিষ্কার করে এ হাজতি টাবু শেখ টনিকের আপন চাচাতো ভাই এবং মামলার বাদী লাবু শেখের আপন ভাই।
পিবিআই সূত্র জানায়, টাবু শেখকে খুঁজে পেয়ে তদন্তে গোলমাল বেধে যায়। সন্দেভাজন টাবু শেখ নাবালক হওয়ায় তার রিমান্ড আর পাওয়া যায় না। ওদিকে লাবু শেখ তদন্তে অসহযোগিতা শুরু করেন। টনিকের মাও ধাঁধায় পড়ে যান। তিনি আদালতে গিয়ে বলেন, তার ছেলে হত্যায় পিবিআই শুধু শুধু তার পরিবারের লোকজনকে ফাঁসাচ্ছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা সে পথেই অন্য পন্থা অবলম্বন করতে থাকেন। খুঁজে বের করা হয় টাবু শেখের বন্ধু-বান্ধবদের। একে একে গ্রেফতার করা হয় চারজনকে। যারা সবাই আদালতে স্বীকার করেন, টনিকের ব্যাংক থেকে উঠানো ১২ লাখ টাকার জন্যই টাবু শেখসহ টনিকের ঘরে ঢুকেছিলেন।
আলমারি খোলার শব্দে টনিক জেগে যায় এবং আবছা আলোতে টাবুকে দেখে চিনে ফেলেন। তখন টনিক তার চাচাত ভাইকে বলেন- ‘তুই কী করিস?’ টাবু তখন তার হাতে থাকা দা দিয়ে ভাইকে কোপ মারে। আগে থেকেই খুলে রাখা দরজা দিয়ে সবাই দৌঁড়ে পালায়। আহত টনিক চোরদের পেছন পেছন কিছুদূর দৌঁড়ে গিয়ে পড়ে যান।
অবশেষে আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, টাবুর খাটের নিচ থেকে খুনে ব্যবহৃত দা-টি উদ্ধার করা হয়। ঘটনার তদন্ত শেষে আদালতে জড়িতদের বিরুদ্ধে খুনসহ ডাকাতির অভিযোগ আনেন পিবিআইর কর্মকর্তা।