ঘূর্ণিঝড় আম্পান আসছে সিডরের মতো শক্তি নিয়ে
২০০৭ সালে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর, তাতে তছনছ হয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল, প্রাণ হারিয়েছিল দুই হাজারের বেশি মানুষ।
তার এক যুগ পরে এখন যে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে বাংলাদেশ, সেই আম্পান সিডরের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এর কেন্দ্রে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাওয়ায় এটি সোমবার পরিণত হয়েছে সুপার সাইক্লোনে।
বঙ্গোপসাগরের জানা ইতিহাসে দ্বিতীয় সুপার সাইক্লোন হিসেবে ধরা হচ্ছে আম্পানকে। প্রথম সুপার সাইক্লোনটি ছিল ১৯৯৯ সালের উড়িষ্যা সাইক্লোন।
ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের প্রধান এস এন প্রধান বলছেন, “আমরা তাই আম্পানকে মোটেই হালকাভাবে নিচ্ছি না, কারণ এনিয়ে দ্বিতীয়বার ভারত একটি সুপার সাইক্লোনের মুখোমুখি হচ্ছে।”
উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের বিস্তৃত এলাকায় সব ধরনের নৌ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ট্রেন চলাচলও হয়েছে স্থগিত। মঙ্গলবার থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বৃষ্টিপাতের আভাস দেওয়া হয়েছে।
এই পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টির গতিপথ বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে উপকূলে আঘাত হানলেও এ বিস্তৃতি থাকবে বাংলাদেশের হাতিয়া পর্যন্ত।
বুধবার দুপুর নাগাদ উপকূলে আঘাত হানার সময় ঝড়টির তীব্রতা এখনকার চেয়ে কমে আসবে বলে ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের অনুমান; তবে তখনও তা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপে থাকবে।
এখন ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ২৪০ থেকে ২৫০ কিলোমিটারের মতো, যা ২৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল। তবে উপকূলে আঘাত হানার সময় এর গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার হতে পারে।
কোভিড-১৯ মহামারীকালে এই ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলের হাজারের কম দূরত্বে আসার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক নানা ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে।
মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে বলা হয়েছে ৬ নম্বর বিপদ সঙ্কেত দেখাতে।
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
২২ মে অমাবস্যা থাকায় ঘূর্ণিঝড় ও অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, “আড়াইশ কিলোমিটার বেগের ঝড় যখন বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করবে তখনও ১৫০-১৬০ কিলোমিটার বেগে এগোতে পারে। উপকূলে আসার পরই গতি কমে আসবে, বৃষ্টির প্রবণতাও বাড়বে।”
মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশ উপকূলে বৃষ্টির আভাস দেন তিনি।
সিডরের উৎপত্তি যেখানে ছিল, আম্পানের উৎপত্তিও বঙ্গোপসাগরের একই এলাকায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছে। গত ডিসেম্বরে আঘাত হানা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মতোই এগোচ্ছে আম্পান।
বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান খান জানান, সুপার সাইক্লোন আম্পান সোমবার রাত ৯টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১০২০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
তখন ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।
আম্পান আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে পারে এবং পরে দিক পরিবর্তন করে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে এগিয়ে সুন্দরবনের কাছ দিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
গত বছরের মে মাসে আরেকটি শক্তিশালী ঝড় ফনীও একই পথে আঘাত হেনেছিল, তার ছয় মাস পরের বুলবুলের গতিপথও ছিল প্রায় একই রকম।
আবহাওয়াবিদ রহমান বলেন, “ভৌগলিক ও আবহাওয়াগত কারণে ঘূর্ণিঝড় এ অঞ্চলকে ‘চ্যানেল’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রূপ নেওয়ার পর ডান দিকে মোড় নেয়। এবারও তাই হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সুপার সাইক্লোন আম্পানের ব্যাস বেশ বড়। এ ধরনের ঝড় শেষ মুহুর্তেও সামান্য দিক পরিবর্তন করতে পারে। এটি উড়িষ্যা উপকূলয় হয়ে উত্তর দিকে সরে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উপকূলে আসবে। এবারও সুন্দরবন অংশ পাবে।”
সুন্দরবনে প্রস্তুতি
এক যুগ আগের সিডরের ঝড়ও গিয়েছিল সুন্দরবনের উপর দিয়ে, যা রক্ষা করেছিল উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। বুলবুলের ক্ষেত্রেও ঢাল হয়ে ছিল সুন্দরবন।
জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার আম্পানের সম্ভাব্য যে গতিপথ দেখিয়েছে, তাতে উপকূল অতিক্রম করার সময় এ ঝড়ের কেন্দ্র বা চোখ থাকতে পারে সুন্দরবনের ওপর।
বন অধিদপ্তরের (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল) বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, “এবারের সুপারসাইক্লোনের প্রভাব সুন্দরবনেও পড়বে। আমরা ইতোমধ্যে সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট এলাকাসহ সবাইকে নিরাপদে অবস্থান নেওয়ার জন্যে সতর্ক করে দিয়েছে। মাছজীবি ও বনজীবিদেরও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্যে বলেছি।”
মানুষের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেলেও বনের ক্ষয়ক্ষতি ঝড় থেকে এড়ানো সম্ভব হয়ে উঠে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে বণ্যপ্রাণীরা। সিডর, আইলার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এরা বরাবরই আড়ালে থাকে। বড় ক্ষতি হলেও তার পরিসংখ্যানগত তথ্য হয়ত পাওয়া যায় না। কিন্তু ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বরাবরের মতো নতুন চর ও উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচি নেওয়া হয়।”
আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, “৯১ এর প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের পরে উপকূলে বনায়ন করার কর্মসূচি জোরদার করা হয়। বরাবরের মতো ঝড়ে ঢাল হিসেবে থাকে আমাদের সুন্দরবনসহ বনাঞ্চলগুলো। এক্ষেত্রে বনাঞ্চল রক্ষায় সবার ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী কাযক্রম নেওয়ায় সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপও জরুরি।”
উপকলীয় বনাঞ্চল থাকলে জলোচ্ছ্বাসের প্রাথমিক ক্ষতি ও ঝড়ের তীব্র গতি কমানো বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ঝড়ের আগে সবাইকে সতর্ক করতে দ্বীপ জেলা ভোলায় চলছে মাইকিং
আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সোমবার সচিবালয় থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ ও নিচু এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে, এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৫১ লাখ ৯০ হাজার ১৪৪ জন মানুষকে আশ্রয় দেওয়া যাবে।
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট হওয়ায় সব ধরনের স্বাস্থ্য বিধি মেনে লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করা হবে জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে আশ্রয়কেন্দ্রে সবাইকে নিরাপদে রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আসবেন, তাদের সবাইকে মাস্ক পরে আসতে বলা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকিং করে সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে কাজ শুরু করেছেন।
মঙ্গলবার রাতের মধ্যে সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হবে জানিয়ে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, সোমবার দুপুর পর্যন্ত ২ হাজার ৫৬০ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন।
“একটি মানুষকেও যাতে প্রাণ হারাতে না হয় সে ব্যাপারে সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি। যেসব মানুষ ঝুঁকিতে আছেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগেই তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হবে। অন্য যে কোনো দুর্যোগ থেকে এবার সব থেকে বেশি সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।