ঘন কুয়াশায় ফ্লাইট ওঠানামায় বিপত্তি, যাত্রীরা বিপাকে
ঘন কুয়াশার কারণে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় প্রতিদিনই বিমান ওঠানামা বিঘ্নিত হচ্ছে। মধ্যরাত থেকে দিনের অনেকটা সময় দেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দরটিতে নামতে পারছে না বিমান। উড্ডয়নের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘন কুয়াশা। এর ফলে দেরিতে ফ্লাইট ছাড়ায় যাত্রীদের দুর্ভোগ যেমন বাড়ছে তেমনি সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতেও বিলম্ব হচ্ছে। কয়েকদিন ধরেই এমন অবস্থা বিরাজ করছে শাহজালাল বিমানবন্দরে। ঢাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। কুয়াশা যতদিন থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নভোএয়ারে করে ঢাকায় আসার জন্য দিনাজপুরের বাসিন্দা প্রসুন চক্রবর্তী মঙ্গলবার দুপুর দুইটার মধ্যে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে যান। তিনটায় ফ্লাইট থাকায় এক ঘণ্টা আগেই বিমানবন্দরে হাজির হন তিনি। অনেক সময় অপেক্ষা শেষে দুই ঘণ্টা পর বিমানটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
প্রসুন চক্রবর্তী বলেন, ‘ঢাকায় জরুরি কাজ থাকায় সড়কপথে না গিয়ে বিমানে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। সেই অনুযায়ী তিনটায় নভোএয়ারে যাওয়ার জন্য টিকিট সংগ্রহ করি। বিমান ছাড়ার তিন ঘণ্টা আগে দুপুর ১২টায় বাসা থেকে বের হই। দুইটা নাগাদ বিমানবন্দরে পৌঁছাই। কিন্তু কুয়াশার কারণে দুই ঘণ্টা পর বিমান ছেড়ে যাওয়ায় পাঁচটার মধ্যে ঢাকায় প্রবেশের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ফ্লাইট দেরিতে ছাড়ায় বাড়তি টাকা খরচ তো আছেই।’
প্রসুন চক্রবর্তী আরও জানান, ‘মঙ্গলবার সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট থেকে ছেড়ে আসা এয়ারলাইন্সগুলোর সকালের ফ্লাইটগুলো বাতিল করতে হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঘন কুয়াশার কারণে ফ্লাইট দেরি এবং বাতিলের এই সব ঘটনা ঘটছে।
শুধু মঙ্গলবারই নয়, সপ্তাহখানেক ধরে দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালাল থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোতে ঘন কুয়াশার কারণে সময়মতো ফ্লাইট ওঠানামা করতে পারছে না। এতে দুর্ভোগের পাশাপাশি অপচয় হচ্ছে কর্মঘণ্টা। অধিকাংশ যাত্রী জরুরি কাজে বের হলেও সঠিক সময়ে নিজের কাজটি করতে পারছেন না। কুয়াশায় ফ্লাইট বাতিল এবং দেরিতে ছেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এক বিমানবন্দরের ফ্লাইট অন্য বিমানবন্দরে অবতরণের ঘটনাও ঘটছে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকদিন ধরেই এমন ঘটনা ঘটছে। সকালের দিকে ঘন কুয়াশার কারণে ভিজিবিলিটি কম থাকায় ফ্লাইট ওঠানামায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা করে ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণ বন্ধ রাখা হচ্ছে। সমস্যাটা বেশি হচ্ছে ভোরবেলায়। বিশেষ করে রাত সাড়ে তিনটা থেকে পাঁচটার মধ্যে যাদের ফ্লাইট তারা বেশি এই সমস্যায় পড়ছেন।
কবিরুল ইসলাম নামে একজন সম্প্রতি পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। তিনি জানান, রাত সাড়ে তিনটায় তার ফ্লাইট ছিল। কিন্তু টানা ৫ ঘণ্টা তাকে বিমানবন্দরে ঠান্ডার মধ্যে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে বসে থাকতে হয়। কিছুই করার ছিল না বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সকালে ফ্লাইট ছেড়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক রুটগুলোতে যাত্রীদের যেতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। কুয়াশা কেটে গেলে বিমান উড্ডয়ন করায় দীর্ঘক্ষণ বিমানবন্দরে সময় কাটাতে হচ্ছে তাদের।
জানা গেছে, কোনো বিমানবন্দরে ভিজিবিলিটি ৬০০-৮০০ এর মধ্যে থাকলে বিমান ওঠানামা করতে পারে। কিন্তু সেই দূরত্ব ৩০০ অথবা তার কম হলে আবহাওয়া অধিদফতর সংকেত দেয়। ফলে পাইলটরা ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিংয়ের সহায়তা নিয়ে থাকেন।শাহজালাল বিমানবন্দর বর্তমানে আইএলএস ক্যাটাগরি-১ এ। ঘন কুয়াশার মধ্যে বিমান অবতরণ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ঢাকার কিছু ফ্লাইট কলকাতা বিমানবন্দরে নামছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের উড্ডয়ন এবং অবতরণে সিডিউল মানা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে বিরক্ত হয়ে অনেকের থেকে টিকিট বাতিল করারও খবর পাওয়া গেছে। গেল সপ্তাহে চট্টগ্রামের ফ্লাইট কলকাতায় এবং মিয়ানমারে জরুরি অবতরণের ঘটনাও ঘটেছে।
কয়েকদিনের ফ্লাইট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঘন কুয়াশার কারণে সম্প্রতি শাহজালালে অবতরণ করতে পারেনি বিমানের পাঁচটি ফ্লাইট। দীর্ঘক্ষণ ঢাকার আকাশে চক্কর মেরে একটি ফ্লাইট চট্টগ্রাম ও তিনটি কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এছাড়া ইউএস-বাংলা, ভিস্তারা এয়ারলাইনস, গালফ এয়ারসহ বেশ কয়েকটি ফ্লাইট দেরিতে অবতরণ করেছে। একই কারণে ঢাকা থেকে ডজনখানেক ফ্লাইট উড্ডয়ন করতে পারেনি।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান
বলেন, ‘আমাদের বিমানবন্দরগুলোর যে রানওয়ে ক্যাটাগরি সেই ক্যাটাগরি আপগ্রেডেশনের জন্য আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। শাহজালাল বিমানবন্দর এখন ক্যাটাগরি-১ রয়েছে সেটাকে আপগ্রেড-২ এ পরিণত করা হবে। তবে ক্যাটাগরি আপগ্রেড-২ করলেও ভিজিবিলিটি এমন হয় যে তাতেও বিমান ল্যান্ড করতে পারবে না। কারণ প্লেনের একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব রয়েছে, হাইট রয়েছে। যদি পাইলট বুঝতে না পারে তবে ল্যান্ড করতে পারে না। যেহেতু মাঝে মাঝে এখন ঘন কুয়াশায় হচ্ছে মূলত তখন ফ্লাইট ল্যান্ড করতে পারছে না।’
এদিকে এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘন কুয়াশা এবং ভিজিবিলিটি কম হওয়ায় ফ্লাইট ওঠানামায় সমস্যার পাশাপাশি জ্বালানি খরচও বাড়ছে। একটি ফ্লাইট যে জ্বালানি নিয়ে রওনা হচ্ছে, সঠিক সময়ে রানওয়েতে নামতে না পারায় বাড়তি জ্বালানি গুণতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে এয়ারলাইন্সগুলোর। কুয়াশার কারণে বিমান ছাড়াও হেলিকপ্টার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ফ্লাইট অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিমানবন্দরের উন্নয়ন স্বাভাবিক করতে পারলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।
বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘন কুয়াশার মধ্যেও রানওয়ে দেখা যাবে এমন প্রযুক্তি শাহজালালে নেই। ফলে এমন সমস্যা সহসাই কেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আধুনিক প্রযুক্তি থাকলে অনেক সময় ৮০০ মিটারের মধ্যে রানওয়ের অবস্থান কম দেখা গেলেও ফ্লাইট অবতরণ করা সম্ভব। তবে পাইলটরা এই ঝুঁকি নিতে চান না।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, প্রতিবেশী দেশগুলো অত্যাধুনিক ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) ব্যবহার করলেও শাহজালালে এখনো পুরনো ব্যবস্থা রয়ে গেছে। তাই এই দুর্ভোগ কমাতে সব বিমানবন্দরে দ্রুত উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের দাবি জানিয়েছেন তারা।