গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা সময়োপযোগী উদ্যোগ: টিক্যাব
সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য গ্রামীণফোনের সিম বিক্রিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দেওয়া নিষেধাজ্ঞাকে সময়োপযোগী ও সাহসী উদ্যোগ বলে মন্তব্য করেছে টেলি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)।
বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিটিআরসিকে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানায় সংগঠনটি।
বিজ্ঞপ্তিতে টিক্যাব আহ্বায়ক মুর্শিদুল হক বলেন, মোবাইল অপারেটরগুলোর সেবার মান মূলত নির্ভর করে গ্রাহক অনুপাতে বেতার তরঙ্গ বা স্পেকট্রামের পরিমাণ, ফাইবার অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক ও মোবাইল টাওয়ার আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ওপর। কিন্তু আমাদের অপারেটরগুলোর অবস্থা এ ব্যাপারে খুবই নাজুক। বিটিআরসি, আন্তর্জাতিক সংস্থা আইটিইউ ও বিভিন্ন সংস্থার সেবার মানদণ্ডের মাপকাঠিতে আমাদের দেশের অপারেটরগুলো এখনো পেছনের সারিতে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ইন্টারনেটের গতি মাপার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওকলার জুন ২০২১ সালের ‘স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স’ মতে, বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫ নম্বরে। বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে শুধুমাত্র যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও চরম অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ভেনেজুয়েলা। গত ১ এপ্রিল সর্বশেষ বেতার তরঙ্গ নিলামের পর গ্রামীণফোনের মোট একসেস তরঙ্গ দাঁড়িয়েছে ১০৭ দশমিক ৪০ মেগাহার্জে, রবির ১০৪ মেগাহার্জে, বাংলালিংকের ৮০ মেগাহার্জে ও টেলিটকের ৫৫ দশমিক ২০ মেগাহার্জে। দেশে বর্তমানে মোবাইল গ্রাহক প্রায় ১৭ কোটি ৬৯ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক প্রায় ৮ কোটি ২৪ লাখ ৮০ হাজার, রবির গ্রাহক ছিল ৫ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার, বাংলালিংকের ৩ কোটি ৬৫ লাখ ৭০ হাজার ও টেলিটকের ৬০ লাখ ৯০ হাজার। গ্রাহকপ্রতি বেতার তরঙ্গের হিসেবে দেশের অপারেটরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গ্রামীণফোনের। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের অপারেটরগুলো পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশসহ বেশিরভাগ দেশের তুলনায় এখনো অনেক পিছিয়ে আছে।
তিনি বলেন, ধীরগতির ইন্টারনেট, কলড্রপ, মিউট কল, ইন্টারনেট প্যাকেজের নামে প্রতারণাসহ মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগের শেষ নেই। বিটিআরসি জমা পড়া অভিযোগের প্রায় ৯০ শতাংশই সেবার মান নিয়ে। আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন আর নানা অফারের ফাঁদ পেতে কাঙ্ক্ষিত সেবা না দিয়েই গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো। ভয়েস কল কিংবা ইন্টারনেট কোনটিতেই মানসম্পন্ন সেবা দিতে পারছে না অপারেটরগুলো। নিজেদের অর্থে কেনা ইন্টারনেট প্যাকেজ দুর্বল নেটওয়ার্ক ও সময়সীমার কারণে পুরোটা ব্যবহার করতে পারছে না গ্রাহকরা।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টিক্যাব অব্যবহৃত ইন্টারনেট ডাটা ফেরতের দাবি জানিয়ে আসলেও নানা অজুহাতে ডাটা ফেরত দিচ্ছে না অপারেটরগুলো। বাজে নেটওয়ার্কের কারণে কলড্রপের ও মিউট কলের শিকার হয়ে একই কলের জন্য একাধিকবার টাকা গুনতে হচ্ছে গ্রাহককে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ মাসে গ্রাহকের ৫২ কোটি ৫৯ লাখ মিনিট কল ড্রপ হয়েছে। অপারেটরগুলো ক্ষতিপূরণ দিয়েছে মাত্র ১১ কোটি ৪৫ লাখ মিনিট। যা গ্রাহকদের খরচ করা টক টাইমের মাত্র ২২ শতাংশ। এতে ৪০ কোটি ৯৩ লাখ মিনিট কল ড্রপের বিপরীতে গ্রাহকদের প্রায় ১৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। যেখানে প্রতিটি কলড্রপের জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে সেখানে অপারেটররা প্রতি ৩ থেকে ৭ মিনিটের বিপরীতে ১ মিনিট করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে অবস্থা আরও শোচনীয়। কোনো যানবাহনে উঠলে ও রুমের ভেতরে ঢুকলেই ফোর জি ইন্টারনেট সেবা পরিণত হয়ে যাচ্ছে টু জিতে।
টিক্যাব আহ্বায়ক বলেন, মোবাইল অপারেটরগুলোর সেবা মান বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ফাইবার অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা। আর এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কিন্তু নানা অজুহাতে অপারেটরগুলো তাদের কাছ থেকে সেবা নিচ্ছে না। যে কারণে এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলোতে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করছে না। আবার অপারেটরগুলো অভিযোগ করছে এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলোর অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের মান সন্তোষজনক নয়, তাই তারা নিচ্ছে না। এ অবস্থায় আদতে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ গ্রাহকরা। বর্তমানে গ্রামীণফোন মাত্র ১২ ভাগ, রবি ১৮ ভাগ, বাংলালিংক ৩১ ভাগ, টেলিটক ৬৪ ভাগ অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করছে।
তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে নিম্নমানের সেবা দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিলেও সেবার মান উন্নয়নে নজর নেই প্রতিষ্ঠানগুলোর। বরং তাদের দৃষ্টি এখন মোবাইল সেবার পাশাপাশি ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) সার্ভিস, ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিফোনি সার্ভিস প্রোভাইডার (আইপিটিএসপি), ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ), পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন), মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের প্রতি। যে সেবা প্রদানের জন্য বিটিআরসি তাদের লাইসেন্স দিয়েছে সেটি উন্নত না করে নতুন নতুন এসব লাইসেন্স চায় প্রতিষ্ঠানগুলো।
মুর্শিদুল হক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অপারেটরগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকরা অভিযোগ জানিয়ে এলেও এতদিন তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে এ নিষেধাজ্ঞাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করে গ্রাহক স্বার্থরক্ষায় সবগুলো অপারেটরকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি জমে থাকা গ্রাহক অভিযোগগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি ও অপারেটরগুলোর সেবার মান নিশ্চিতে বিটিআরসিকে মনিটরিং জোরদার করার আহ্বান জানাচ্ছি।