খেলাপি ঋণ ঠেকাতে নতুন পদ্ধতি
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে ঋণের ঝুঁকি পরিমাপের নতুন পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী অর্থবছর থেকে এই পদ্ধতিই ব্যবহার করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ‘উদ্বেগজনক’ পর্যায়ে পৌঁছার প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার ঢাকায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে ঋণের ঝুঁকি পরিমাপের নতুন নীতিমালা উদ্বোধন করেন গভর্নর ফজলে কবির।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন পদ্ধতি ‘ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর)’ এর মাধ্যমে ঋণ গ্রহিতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, সে বিষয়টি সঠিকভাবে বের করা যাবে। আবার ব্যাংকের সমস্ত ঋণ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, সে বিষয়েও ধারণা পাওয়া যাবে। এই পদ্ধতিতে খাতভিত্তিক ঝুঁকিও বের করা যাবে।
গভর্নর ফজলে কবির বলেন, এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের ঝুঁকি কমে আসবে। ঋণঝুঁকি নির্ধারণে ২০০৫ সালে ‘ক্রেডিট রিস্ক গাইডলাইন ম্যানুয়াল (সিআরজিএম)’ জারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতদিন ওই নীতিমালাই অনুসরণ করে ঝুঁকি নির্ণয় করে ঋণ দিয়ে আসছিল ব্যাংকগুলো।
নতুন পদ্ধতি চালুর আগে ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত সিআরজিএম ও আইসিআরআর একসঙ্গে অনুসরণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে কেবল আইসিআরআর অনুসরণ করতে হবে।
এই পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলো এখন থেকে প্রত্যেক ঋণগ্রহীতার একটি রেটিং করবে এবং এ-সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার তৈরি করবে। এই রেটিংয়ে পরিমাণ ও গুণগত উভয় ধরনের সক্ষমতার মূল্যায়ন থাকবে। মূল্যায়নের ভিত্তিতে গ্রাহককে চার শ্রেণিতে ভাগ করবে ব্যাংকগুলো।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, রেটিং করার ক্ষেত্রে একটি পার্টি বা গ্রাহকের পরিমাণগত সক্ষমতায় ৬০ শতাংশ নম্বর এবং গুণগত সক্ষমতায় ৪০ শতাংশ নম্বর থাকবে।
পরিমাণগত সক্ষমতা সূচকে ৬০ নম্বরের মধ্যে মোট গৃহীত ঋণ ও আর্থিক সক্ষমতায় ১০, চলতি দায় ও তরল সম্পদে ১০, মুনাফার সক্ষমতায় ১০, সুদ পরিশোধের সক্ষমতা ও নগদ প্রবাহের ওপর ১৫, পরিচালনগত দক্ষতায় ১০ এবং ব্যবসার মানের ওপর পাঁচ নম্বর থাকবে।
এছাড়া গুণগত সক্ষমতায় ৪০ নম্বরের মধ্যে কার্যদক্ষতার আচরণে (পারফরম্যান্স বিহেবিয়ার) ১০, ব্যবসা ও খাত ঝুঁকিতে ৭, ব্যবস্থাপনা ঝুঁকিতে ৭, জামানত ঝুঁকিতে ১১, সম্পর্ক ঝুঁকিতে ৩, পরিপালন ঝুঁকিতে ২ নম্বর থাকবে।
তবে কোনো গ্রাহক গুণগত রেটিংয়ে যত নম্বরই পাক না কেন, পরিমাণগত রেটিংয়ে ৫০ শতাংশ নম্বর না পেলে তাকে ‘আনএকসেপ্টেবল’ রেটিং দেওয়া হবে। নীতিমালা অনুযায়ী এখন থেকে নতুন ঋণ, ঋণ নবায়ন ও বিদ্যমান ঋণ বর্ধিতকরণের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে অবশ্যই এ রেটিং করতে হবে ব্যাংকগুলোকে।
এ রেটিং পদ্ধতিটিকে ফলপ্রসূ করার জন্য কোন কোন খাতের গ্রাহকের রেটিং করতে হবে, তার কিছু খাত-উপখাত নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শিল্প খাতের মধ্যে তৈরি পোশাক, বস্ত্র, খাদ্যপণ্য, ওষুধ, রাসায়নিক, সার, সিমেন্ট, সিরামিক, জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙা, পাটকল, ইস্পাত প্রকৌশল, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে, কৃষিভিত্তিক ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সেবা খাতের আবাসন ও নির্মাণ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, টেলিকমিউনিকেশন ও অন্যান্য সেবার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ রেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করে ঋণ দিতে হবে।
তবে ভোক্তাঋণ, ৫০ লাখ টাকার কম ঋণ আছে- এমন ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠান, স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণ, ক্ষুদ্রঋণ, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ রেটিং অনুসরণ করতে হবে না।
নীতিমালা অনুযায়ী পরিমাণগত সক্ষমতা মূল্যায়ন করবেন একজন ঋণ কর্মকর্তা। শাখা ব্যবস্থাপক করবেন গুণগত মূল্যায়ন। ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে আইসিআরআর। এর নির্বাহী সারসংক্ষেপ (এক্সিকিউটিভ সামারি) প্রতিবেদন অনুমোদন করবেন ব্যাংকের প্রধান ঝুঁকি কর্মকর্তা।
আইসিআরআর নীতিমালায় এমন ২০টি মডেল দেওয়া আছে, যা কার্যকরভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা হলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণপ্রাপ্তির যোগ্যতা অনুযায়ী ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এই মডেল সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর বাইরে দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা যেসব ঋণ ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে, তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এ মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের গত দুই সরকারের মেয়াদে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে উলেখযোগ্য উন্নতি হলেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ। এই পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ব্যাংক মালিক ও প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠক করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি যে কোনোভাবে ঠেকানোর আহ্বান জানান। তার সাত দিনের মধ্যে ঋণের ঝুঁকি হ্রাসে নতুন নীতিমালা চালুর ঘোষণা দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।