খুলনার সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীদের দুর্দিনের আভাস
কৌশিক দে
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম, আমরা বলি সংবাদ মাধ্যম। খুলনা দেশের পুরাতন বিভাগীয় শহর। নানা ঐতিহ্যে সমুন্নত খুলনা। এদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম ও সংকটে সব সময়ে এগিয়ে ছিল খুলনার সংবাদ মাধ্যম। দেশের দুর্যোগ-দুর্বিপাকে হার না মানা এ অঞ্চলের সাংবাদিক, সংবাদকর্মী ও এমন কী গণমাধ্যম তাই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ- খুলনার এই গণমাধ্যমকে এক বড় সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। একদিকে সংবাদপত্র মালিকরা যেমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন, অন্যদিকে এসব সংবাদপত্রে কর্মরত সাংবাদিক, সংবাদকর্মী ও সংবাদসেবীরাও গভীর সংকটে রয়েছেন। আগামী দিনে এই সংকট কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
খুলনা জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিকের সংখ্যা বর্তমানে ২৩টি। আর সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও ত্রৈমাসিক পত্রিকার সংখ্যা ৪০টি। খুলনার এসব পত্রিকার মধ্যে হাতে গোনা ৪/৫টি দৈনিক পত্রিকা স্বল্প পরিসরে প্রকাশিত হচ্ছে। বাকীগুলো ২৭ মার্চ থেকে প্রিন্ট ভার্সন প্রকাশনা বন্ধ রয়েছে। আবার দুয়েকটি তাদের অনলাইন ভার্সন সচল রেখেছে। গড় হিসেব করলে খুলনার দৈনিক পত্রিকা সমুহে সাংবাদিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে প্রায় শ’ তিনেক মানুষ কর্মরত রয়েছেন। অবশ্য এ সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে। আবার ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিক, সংবাদকর্মী আরও শতাধিক। অপরদিকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ও স্থানীয় এসব দৈনিক মানুষের দ্বোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন আরও তিন’শ সংবাদপত্রসেবী। সব মিলিয়ে এই মাধ্যমে খুলনায় জড়িত হাজারটি পরিবার। যে পরিবারগুলোর সাথে আরও কয়েক হাজার মানুষ নির্ভরশীল। ‘করোনা ভাইরাস’এই পরিবারগুলোকে এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে স্থানীয় সংবাদপত্রে কর্মরত সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের অবস্থা দিন দিন সংকটাপন্ন করে তুলছে। একদিকে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ, অন্যদিকে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার চিন্তা; তাদের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আর এই সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে, সংবাদপত্রসেবীদের পত্রিকা বিলি-বল্টন না করার সিদ্ধান্ত। অবশ্য এতে স্বল্প বা নামমাত্র সংখ্যায় প্রকাশনাকারীদের কিছুটা সুবিধা হলেও ভয়ানক সংকটে পড়েছে বহুল প্রচারিত ও অধিক জনবল কাঠামোয় প্রকাশিত পত্রিকাগুলো। তারা যেমন কোনভাবে তাদের প্রকাশনা সাধারণ পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না, তেমনি বিজ্ঞাপন গ্রহণ ও এ বাবদ মূল্যও আদায় করতে পারছেন না। ফলে তাদের উপর নির্ভরশীল সাংবাদিক-সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতাসহ পাওনা পরিশোধ নিয়ে একটু হলেও ভাবনায় পড়েছেন (যারা নিয়মিত সাংবাদিক-সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা দেন তাদের ক্ষেত্রে)। এই ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধায় রয়েছেন যারা তাদের সাংবাদিক-সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা দেন না তারা। এই সংবাদপত্র মহাজনেরা নামমাত্র কিছু সংখ্যা প্রকাশ করলেও এখন তাদের সেই ছাপা খরচটাও বেঁচে যাচ্ছে।
আমি আগেই বলেছি, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণরোধের কারণ দেখিয়ে খুলনার সংবাদপত্রসেবীরা গেল ২৬ মার্চ থেকে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ রেখেছেন। সেই হিসেবে এক পক্ষকালব্যাপী খুলনার হাজার হাজার পাঠক পত্রিকা পড়তে পারছেন না। সংবাদপত্রসেবীদের অভিযোগ, পাঠক করোনা ভাইরাসের এখন পত্রিকা নিতে চাচ্ছে না, তাই তারা ঝুঁকি নিয়ে আর পত্রিকা বিলি করতে চান না। এমন কী অনেক সরকারি-বেসরকারি অফিস ও সচেতন মানুষের পক্ষ থেকেও সংবাদপত্রসেবীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের জুজুর ভয় বা গুজবটি কারা ছড়িয়েছে, এখনও আমরা জানতে পারছি না। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ সংবাদপত্র ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য দিয়ে বলে আসছে, ‘সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি’র কোন প্রমাণ মেলেনি। তাই সংবাদপত্র পড়ুন। অথচ এই সংবাদপত্র প্রচারণা বন্ধ থাকায় পাঠক যেমনভাবে সরকারি সঠিত তথ্য ও নির্দেশনা বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি সংবাদপত্রসেবীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি সংবাদপত্র এক গভীর সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
একজন রিপোর্টার হিসেবে সাধারণ মানুষের সাথে কমবেশী প্রতিদিনই দেখা-সাক্ষাৎ বা কথা হয়। এসব মানুষগুলোর বেশীরভাগই খবরের পিছনের খবর জানতে চান; পড়তে চান। একটি পত্রিকা থাকলে অনেকেই ঘরে বসে বড় একটি সময় কাটানোরও সুযোগ পেতেন, যা এখন হয়ে উঠছে না।
আবার খুলনার প্রায় দেড়শ’ সংবাদপত্রসেবী পত্রিকা বিলি করতে না পেরে দুর্বিষহ জীবন পার করছে। অনেকের বাসায় স্বাভাবিক খাবার সংগ্রহও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় থাকা কমপক্ষে ২০জন সংবাদপত্রসেবীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছি। তারা অনেকেই বলেছেন, মার্চের ২৬ তারিখ পর্যন্ত গ্রাহককে পত্রিকা দিয়েও অনেকেই বিল পাননি। পত্রিকা বন্ধ থাকার অজুহাতে অনেক গ্রাহকই বিল দিতে চাচ্ছে না। ফলে তাদের কোন সঞ্চয় না থাকায় কঠিন সময় পার করছেন। এই সংবাদপত্রসেবীরা বলেছেন, পত্রিকা বিলির পক্রিয়া চালু থাকলেও তারা বেঁচে থাকতে পারতেন। আগে ২০টি পত্রিকা বিক্রি হলেও এখন কম হলেও ১০টি বিক্রি হতো। কিন্তু তাদের এই আকুতি কে শুনবে।
এখন আসি, শেষ কথায়। সংবাদপত্রসেবীরা তাদের কষ্টের কথা কোথাও কোথাও বলতে পারলেও ‘বুক ফাঁটে তো মুখ ফাঁটে না’ বেদনায় নীল হয়ে রয়েছেন সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ‘তোমার কথা হেথা বলে না তো কেউ, করে শুধু মিছে কোলাহল’ প্রখ্যাত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের গানের প্রথম কলির মতো; এদের কথা কেউ বলে না অবস্থা। স্বল্প বেতন-ভাতার অনিশ্চয়তার পাশাপাশি প্রকাশনা বন্ধে এসব সাংবাদিক বন্ধুদের মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তুলছে। সামনে পবিত্র রমজান, ঈদুল ফিতর! কীভাবে পার হবেন এ নিয়ে দুচিন্তা কাটছে না। করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচার চেয়ে এই যন্ত্রণা তাদের কাছে কোন অংশেই কম নয়।
আমি বিশ্বাস করি, এই সংকট হয়তো কেটে যাবে। আমরা এ যুদ্ধেও জয়ী হবো। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিরা এসব সংকটে এগিয়ে অনেকটাই আশার আলো দেখবে পর্দার অন্তরালের মানুষগুলো। সকলে সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ, খুলনা ব্যুরো।