January 19, 2025
আঞ্চলিকলেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

খুলনাঞ্চলের ১০ লাখ মানুষের দুঃখ ভবদহের ২১ ভেল্ট স্লুইচ গেট

* লক্ষাধিক মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার

মল্লিক খলিলুর রহমান, অভয়নগর
যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর উপজেলাসহ খুলনার ৩৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ১০ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার নাম ভবদহের ২১ ভেল্ট স্লুইচ গেট। বন্ধ হতে চলেছে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্টে (টিআরএম) প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
ভবদহ সমস্যার সমাধানের নামে প্রজেক্টের পর প্রজেক্ট গ্রহণ করে যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি টাকা শুধু লুটপাটই হয়েছে, ন্যূনতম সমাধান হয়নি-এ অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্থ ও পানিবন্দী সাধারণ মানুষের। আর তার প্রমান মেলে ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধ গ্রাম, বিল ও সংশ্লিষ্ট নদীর বর্তমন অবস্থা দেখলে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়নে ভবদাহের সব থেকে বড় ২১ ভেল্ট স্লুইস গেটের ১৮টি কপাটিই বন্ধ হয়ে আছে। স্লুইচ গেট দিয়ে পানি প্রবাহিত না হওয়ায়। গেট সংলগ্ন শ্রীনদী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী ৩টি নদী ও আমডাঙ্গা খালের আবস্থাও ভয়াবহ।
জানা যায়, সবুজ বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে ১৯৬০ সালের দিকে যশোরের সদর, মনিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলা এবং খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহ নামকস্থানে শ্রীনদীর উপর নির্মাণ করা হয় ২১ ভেল্টের স্লুইচ গেট। পরবর্তীতে ভবদহের ২শ’ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৮ লক্ষাধিক মানুষের মরণ ফাঁদে পরিণত হয় এই স্লুইচ গেট। গেটটিতে মোট কপাট রয়েছে ২১টি। গেটটি দিয়ে শ্রীনদী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী নদীসহ বিল কেদারিয়া, বিল বকর ও বিল আড়পাড়াসহ যশোর ও খুলনা এলাকার মোট ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশন হয়ে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে বর্ষা মৌসুমে বিল তীরবর্তী আশেপাশের শত শত গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এসময় পানিবন্দী মানুষ আন্দোলন শুরু করলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক ও কারিগরী সহায়তায় ভবদহের পানি নিষ্কাশন প্রকল্প (কেজিডিআরপি) গ্রহণ করা হয়। ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৫৭ কোটি টাকা। সমুদয় অর্থ ব্যয় হওয়ার পরও পানিবদ্ধতার নিরসন হয় না। অভিযোগ ওই অর্থের বড় অংশই লুটপাট হয়। এরপর ২০০৭ সালে ৫৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ২০১০ সালে ৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, দফায় দফায় টিআরএমসহ ছোট ছোট প্রজেক্টে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়। সর্বশেষ ভবদহ গেটের পাশে শ্রীনদী ড্রেজিংয়ে ৫০ লাখ টাকার কাজ চলমান আছে।
অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। অভয়নগর উপজেলা ভবানীপুর গ্রামে শ্রী নদীর উপর নির্মিত ভবদহ স্লুইসগেট দিয়ে মূলত এলাকার ৫৪টি বিলের পানি নিস্কাশিত হয়। পলি পড়ে এলাকার পানি নিস্কাশনের এক মাত্র মাধ্যম মুক্তেশ^রী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নব্যতা হারিয়েছে। এর ফলে নদী দিয়ে পানি নিস্কাশিত হচ্ছেনা। এ মতাবস্থায় বৃষ্টির পানিতে এলাকার বিলগুলো তলিয়ে গেছে। বিল উপচে পানি ঢুকছে বিল সংলগ্ন গ্রামগুলোতে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দূর্ভোগে পড়েছেন ভবদহাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ। আবার কেউ কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে ঘরের মধ্যে মাচা করে সেখানে থাকছে।
এ উপজেলার বলারাবাদ, বেদভিটা, ডুমুরতলা, আন্ধা, বারান্দী, দিঘলিয়া, কোটা, ডহর মশিহাটি, রাজাপুর, সুন্দলী, ভাটবিলা, সড়াডাঙা, হরিষপুর, ফুলেরগাতী, দামুখালী, দত্তগাতী, জিয়াডাঙা আরও কয়েকটি গ্রামের কোথাও আংশিক আবার কোথাও বেশীর ভাগ ঘর বাড়িতে পানি উঠেছে । গতকাল বুধবার উপজেলার পানিবন্দি গ্রামগুলো ঘুরে ঘুরে মানুষের চরম দূর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে।


এ সময় গ্রামবাসিরা জানান, ইতমধ্যে গ্রামগুলোর শত শত ঘর বাড়িতে পানি উঠেছে। এলাকার রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় অনেক জায়গায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি থেমে গেলেও পানি কোমছেনা। তারা বলেন, নদ-নদী গুলোর অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। নদী ও আমডাঙ্গা খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় এলাকার বিলগুলো বৃষ্টির পানিতে ভরে রয়েছে। বৃষ্টির পানি বিল উপচিয়ে সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ডুকে পরছে। এ জন্য দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। খনন করা পলি নদীর পাড়েই রাখ হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই নদীর পাড়ে রাখা মাটি খালে ঢুকে খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। টিআরএম (টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্টে) নিয়ে না না ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তারা আরও বলেন, টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় অভয়নগর,মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং যশোর সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের দাবী দ্রুত সময়ের মধ্যে পানি নিস্কাশন ও জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য টিআরএম (টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্টে) প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
চলশিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাদির মোল্যা জানান, ১৩টি গ্রাম নিয়ে ইউনিয়ন। এর মধ্যে ৫টি গ্রামের ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। শত শত ঘরবাড়ি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে এলাকার মানুষ তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে খুবই খারাপ আবস্থা দিন যাপন করছেন। এ অবস্থা থেকে স্থায়ী সমাধান পেতে হলে ভবদহের স্লুইস গেটের সবকটি কপাট খুলে দিয়ে টিআরএম প্রকল্প চালু করতে হবে। উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় বলেন, এ ইউনিয়নে ১৪টি গ্রামের আছে। এর মধ্যে ধোপাদী গ্রামের আংশিক সহ ১৩টি গ্রামের ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। এলাকার বিলগুলো আগে থেকেই জলাবদ্ধ হয়ে আছে। এসব বিলগুলোতে দীর্ঘ দিন যাবত কোন ফসলাধি হয় নেই। এলাকার হাজার হাজার মানুষ দূর্ভোগে তাদের পরিবারবর্গ নিয়ে জীবন যাপন করছে। তিনি আরও জানান, এ থেকে স্থায়ী ভাবে পরিত্রান পেতে চাই। স্থায়ী সমাধানের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে আমডাঙ্গা খাল এক শত ফুট প্রস্থ সমান্তরাল করে গভীর ভাবে খননসহ টিএরএম প্রকল্প চালু করতে হবে।
ভবদহ জলাবদ্ধতা নিরসন আন্দোলন কমিটি ও অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক আলহাজ্ব এনামুল হক বাবুল বলেন, ভবদহের আশেপাশের সব নদী ও আমডাঙ্গা খাল খনন করে উজানের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং বিল কপালিয়াসহ খাল-বিলে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্টে (টিআরএম) চালু করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সেচ প্রকল্প চালু করে জলাবদ্ধ এলাকার স্থায়ী কোন সমাধান হবেনা। তাদের দাবীগুলো বাস্তবায়ন করা না হলে এ অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে আরও দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে তিনি জানান।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোরের নির্বাহি প্রকৌশলী মো: তাওহীদুল ইসলাম এ প্রতিনিধি’কে বলেন, নদী থেকে পলি সরানোর জন্য ৫০লক্ষ টাকা ব্যায়ে খনন কাজ চলছে। জরুর ভাবে পানি নিস্কাশনের জন্য আমরা বি,আই,ডি,সি’কে সাথে নিয়ে ভবদহের সংশ্লিষ্ট নদীতে ইলেকট্রিক সেচ পাম্প বসিয়ে জলাবদ্ধ নিরসনের ব্যবস্থা করা হবে। এবং আমডাঙ্গা খালের প্রস্থ ও গভিরতা বাড়িয়ে খাল খননের জন্য চলতি মাসের ১৭তারিখ দরপত্র গ্রহণ করা হবে। এবং এ মাসের শেষে কাজ শুরু করতে পারবো।
তিনি আরও বলেন, পানিবন্দি মানুষের দু:খ কষ্টের কথা চিন্তা করে যে কোন প্রকল্পের মাধ্যমেই হোক পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থায়ী ভাবে জলাবদ্ধ নিরসনের জন্য কোন মানুষের যেন কোন ক্ষতি না হয় এবং সরকারের টাকার যেন অপচায় না হয় সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমরা কাজ করবো। দ্রুত সময়ের মধ্যে মানুষ জলাবদ্ধ থেকে মুক্তি পাবে।

দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ এম জে এফ

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *