কোভিড-১৯: কীভাবে ১৩০ কোটির ভারতে মৃত্যু মাত্র ১০০০?
মাসখানেক আগেও মনে হচ্ছিল করোনাভাইরাসের মহামারীতে ভারতের পরিস্থিতি হয়তো ভয়াবহ হবে; লাখে লাখে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিচ্ছিলেন।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ দেশের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিতে পারে হুঁশিয়ারি দিয়ে ভারতকে তা মোকাবিলার আটঘাঁট বেধে নামারও পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিত্সকরা।
তাদের আশঙ্কা ছিল, ভাইরাসটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে ভারতের বস্তিবাসীদের মধ্যে, যেখানে গাদাগাদি করে থাকা মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধাই পায় না।
কিন্তু বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল দেশটিতে এখনও সেরকম কিছু হয়নি; মারাত্মক খারাপ পরিস্থিতি ভারত এড়াতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে।
মঙ্গলবার পর্যন্ত ভারতে এই মহামারীতে মাত্র ৩১ হাজার ৩৬০ জন আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে মাত্র একহাজার ৮ জন মারা গেছেন। অর্থাৎ ভারতে কোভিড-১৯ মৃত্যুহার প্রতি ১০ লাখে একজনেরও কম (প্রায় দশমিক ৭৬), যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ১০ লাখে ১৭৫ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধে দেশজুড়ের লকডাউনের পদক্ষেপ আপাতত কার্যকরী হয়েছে বলে ভারতের তুলনামূলক ইতিবাচক পরিসংখ্যান থেকে ইঙ্গিত মিলছে।
দেশজুড়ে লকডাউনের মেয়াদ ২১ দিন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে ১৪ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ভারত সংকট জটিল হওয়ার অপেক্ষায় না থেকে তা দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা মোকাবিলায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
“এত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে পরিস্থিতি কী হতো তা আমি কল্পনাও করতে পারি না।”
তবে ভারতের এই সংখ্যার পিছনে বাস্তবতা এতোটা সরল নাও হতে হারে। এর জন্য ভারতের বাহবা নেওয়ার সময় এখনও আসেনি, আরও অপেক্ষা করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও নীতি নিয়ে কাজ করা অলাভজনক সংগঠন পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট শ্রীনাথ রেড্ডি বলেন, অন্তত এই পর্বে, যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল ততটা ক্ষতি ভাইরাসটি করতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে।“তবে এবিষয়ে এখনই শেষ কথা বলে দেওয়া যাবে বলে আমি মনে করি না।”
কতটা দ্রুত ছিল মোদীর সিদ্ধান্ত
গত ২৪ মার্চ ভারতে দেশজুড়ে তিন সপ্তাহের লকডাউনের ঘোষণা দেন মোদী, যা ছিল অভূতপূর্ব মাত্রার একটি সিদ্ধান্ত।
ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। এর চেয়ে বেশি জনসংখ্যার একমাত্র দেশ চীন শহরজুড়ে লকডাউন দিলেও দেশজুড়ে দেয়নি।
এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত উচ্চমূল্যের। কারণ লকডাউনে যাওয়ার অর্থ লাখ লাখ দিনমজুর উপার্জন হারাবেন। কিন্তু লকডাউন না দিলেও ভারতের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ঝুঁকির মধে পড়তো।
একটি মডেলের অনুমান উদ্ধৃত করেছে সিএনএন বলছে, সামাজিক দূরত্বের বিধি প্রতিপালনের ব্যবস্থা না নিলে জুনের মধ্যে ভারতে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ আক্রান্ত হবে। আর ভারতের শীর্ষ মহামারী বিশেষজ্ঞ শুক্রবার বলেন, লকডাউন দেওয়া না হলে দেশে এক লাখের বেশি আক্রান্ত হত।
মাত্র ৫১৯টি করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর ভারত দ্রুতই লকডাউনের ঘোষণা দেয়। অথচ ইতালিতে ৯ হাজার ২০০ জন এবং যুক্তরাজ্যে ৬ হাজার ৭০০ জন আক্রান্ত হওয়ার আগে দেশজুড়ে লকডাউন দেওয়া হয়নি।
এদিকে লকডাউন দেওয়ার আগেই ভারত অন্য ব্যবস্থাও নিয়েছিল। ১১ মার্চ ট্যুরিস্ট ভিসা স্থগিত করে এবং বিগত কয়েক সপ্তাহে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত অঞ্চল থেকে আসা পর্যটকদের কমপক্ষে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখার ঘোষণা দেয় দেশটি।২২ মার্চ থেকে সব আন্তর্জাতিক ও বাণিজ্যিক ফ্লাইটের ভারতে অবতরণ নিষিদ্ধ করা হয় এবং দেশে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল স্থগিত করা হয়।
পক্ষান্তরে চীন, ইরান ও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ থেকে বিদেশিদের ভ্রমণে যুক্তরাষ্ট্র বিধিনিষেধ আরোপ করলেও তবে দেশে বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেনি।
ভারতের সংখ্যায় যদি গলদ থাকে?
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশটি রোববার পর্যন্ত সোয় ৬ লাখের বেশি মানুষের নমুনা পরীক্ষা করেছে, যা পরীক্ষার দিক থেকে প্রশংসিত দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে বেশি।
যে কোনও দেশ কতটা আগ্রাসীভাবে পরীক্ষা করছে তা যখন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মূল্যায়ন করেন তখন তারা শুধু মোট সংখ্যায় সীমাবদ্ধ না থেকে পরীক্ষার ইতিবাচক হারের দিকেও নজর দেন। পরীক্ষায় যদি বড় অংশ পজেটিভ ফল আসে তাহলে তারা ধরে নেন যে কেবলমাত্র গুরুতর- যেমন হাসপাতালে ভর্তি- রোগীদের ক্ষেত্রেই পরীক্ষা করা হচ্ছে।
ডব্লিউএইচওর জরুরি স্বাস্থ্য কর্মূচির নির্বাহী পরিচালক মাইক রায়ান সিএনএনকে বলেন, প্রতিটি পজিটিভ ফলের বিপরীতে কমপক্ষে ১০টি নেগেটিভ ফল থাকলে সেটাকে মুটামুটি ভাল মানদণ্ড হিসেবে ধরা যায়।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশটিতে এখনও পর্যন্ত মোট পরীক্ষার মাত্র ৪ শতাংশের ক্ষেত্রে ফল পজেটিভ এসেছে, যা এই মানদণ্ডের অনেক নিচে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএইচইউ) তথ্য অনুযায়ী এটা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায়ও অনেক কম, যেখানে পজেটিভ প্রায় ১৭ শতাংশ। এটি যুক্তরাজ্যের তুলনায়ও কম, যেখানে সরকারি হিসাবে পজেটিভ প্রায় ২১ শতাংশ।
আরও একটি প্রয়োজনীয় মানদণ্ড হতে পারে মৃত্যু হারের অনুপাত। ভারতে মোট আক্রান্তের প্রায় ৩ শতাংশ মারা গেছেন, যেখানে জেএইচইউর হিসাবে ইতালি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে ১৩ শতাংশের বেশি মারা গেছেন। তাই এটা ধরে নেওয়া যায় যে, ভারত সবচেয়ে গুরুতর উপসর্গসহ ব্যক্তিদের বাইরে অন্যদেরও পরীক্ষা করছে।
তবে এক্ষেত্রে ভারতের মাথাপিছু পরীক্ষার হার অত্যন্ত কম। প্রতি লাখে দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ হাজার ১৭৫ ও যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৭৪০ জনের বিপরীতে দেশটিতে মাত্র ৪৮ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে।রেড্ডি বলেন, ভারত পর্যাপ্ত পরিমাণে পরীক্ষা না করলেও চিকিৎসার সম্ভবত বেশিরভাগ মৃদু ও গুরুতর আক্রান্তদের ধরতে পারছেন।
“কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা যদি ব্যাপক বাড়তো, যা পরীক্ষার ধরা পড়েনি, তাহলে হাসপাতালগুলিতে সংক্রমিতদের ব্যাপক ভিড় হওয়ার কথা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো লক্ষণগুলি ব্যাপকভাবে দেখা যেত।”
আপাতত এধরনেও কোনও ইঙ্গিত নেই। তবে কোভিড-১৯ ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণগুলির চেয়ে আরও বাড়তি উপসর্গ সৃষ্টি করে বলে এর মধ্যে প্রমাণ মিলেছে।
অনেক মৃত্যু অজ্ঞাত থাকছে কি?
ভারত যখন মহামারীর মুখে থাকে না তখনও ভারতের নিবন্ধিত মৃত্যুর মাত্র ২২ শতাংশের ডাক্তারি সনদ থাকে। তার অর্থ হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর আনুষ্ঠনিক কার চিকিত্সক দ্বারা পরিক্ষীত হয় না।
মহামারীর মধ্যেও কিছু মৃত্যুর রাডারে ধরা নাও পড়তে পারে বলে ইতিমধ্যে প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুম্বাইয়ের অন্যতম প্রধান সরকারী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক বলেন, গত সপ্তাহে হাসপাতালে আনা মৃতদেহগুলির করোনাভাইরাস পরীক্ষা হয়নি।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকে দেখা ভাইরাসে আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে আসার তথ্য না পাওয়া গেলে মৃতদেহের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয় না।তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পর্যায়ে দেখে মনে হচ্ছে না যে করোনাভাইরাসে ব্যাপক মৃত্যু হচ্ছে।
অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট সমির সরন বলেন, “এমনকি যদি আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ পরীক্ষা নাও করি ও পর্যাপ্ত পরিমাণে বের নাও হয়, এই পর্যায়ে সত্যিই আমরা সেরকম কোনো নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি এমন কিছু হলে হাসপাতাল বা আইসিইউতে ব্যাপক ভিড় বা মর্গে লাশের স্তুপ দেখা যেত।
তার পরও কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা এই বছরের মৃত্যুর পরিসংখ্যানের সঙ্গে বিগত বছরগুলির তুলনা করতে না পারলে পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন যুক্তরাজ্য ও ভারতভিত্তিক অলাভজনক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ ডায়নামিক্স,ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসির রামানান লক্ষ্মীনারায়ণ।