কুমিল্লার ঘটনায় ইন্ধনদাতাদের খুঁজছে পুলিশ
কুমিল্লা নগরীর নানুয়ার দিঘির পাড়ের একটি অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার অভিযোগে ইকবাল হোসেনসহ চারজনের সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ৯৯৯-এ কল করা ইকরাম ও মণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখা ইকবালকে প্রাধান্য দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি। সঙ্গে আছেন একদল চৌকস কর্মকর্তা।
রোববার (২৪ অক্টোবর) বিকেল পর্যন্ত খবরে জানা যায়, প্রথম দিন ইকরাম ও ইকবালকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও ঘটনার নেপথ্যে কারা রয়েছেন সে ব্যাপারে তারা এখনো মুখ খোলেননি।
সূত্র জানায়, তারা দুইজনই মাদকসেবী। টুকটাক মাদক ব্যবসার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লার একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এটি স্পর্শকাতর। আমরা প্রতিটি বিষয়কে ধরে ধরে আগানোর চেষ্টা করছি। ঘটনার গভীরে কাদের ইন্ধন রয়েছে, তা খুঁজে বের করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এর আগে, শনিবার বেলা ১২টার সময় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় চারজনকে কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের তোলা হয়। পুলিশ ১০দিনের রিমান্ড আবেদন করে। বিচারক মিথিলা জাহান নিপা তাদের সাতদিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
বৃহস্পতিবার রাতে ইকবালকে কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার করা হয়। শুক্রবার বেলা ১২টার সময় কুমিল্লা পুলিশ লাইনসে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে।
ইকরাম-ইকবাল সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে:
মণ্ডপে কোরআন রাখে ইকবাল। কুমিল্লা নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ড দ্বিতীয় মুরাদপুর লস্করপুকুর এলাকার নূর আহম্মদ আলমের ছেলে তিনি। নূর আলম মাছ ব্যবসা করেন।
ইকবালের মা আমেনা বেগম জানান, ইকবাল ১৫ বছর বয়স থেকেই নেশা করা শুরু করে। গত দশ বছর আগে বিয়ে করে ইকবাল। জেলার বরুড়া উপজেলায় বিয়ে করে। তার এক ছেলে হয়। পরে পাঁচ বছর পরে ইকবালের ডিভোর্স হয়। তারপর ইকবাল জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়া বাজার এলাকার কাদৈর গ্রামে বিয়ে করে। এ সংসারে তার এক ছেলে এক মেয়ে। ইকবালের স্ত্রী-সন্তান এখন কাদৈর গ্রামে থাকে।
ইকবালের মা আমেনা বেগম জানান, ইকবাল নেশাগ্রস্ত হয়ে নানানভাবে পরিবারের সদস্যদের ওপর অত্যাচার করতো। বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাটে হাঁটে। গোসলখানার দরজা বন্ধ করে ইয়াবা সেবন করে। ইকবাল মাজারে মাজারে থাকতে ভালোবাসতো। বিভিন্ন সময় আখাউড়া মাজারে যেত। কুমিল্লার বিভিন্ন মাজারেও তার যাতায়াত ছিলো।
ইকবাল পঞ্চম শ্রেণি পাস। ১০ বছর আগে বন্ধুদের সঙ্গে অন্য পাড়ার আরো কিছু ছেলের সঙ্গে মারামারি হয়। এ সময় ইকবালকে পেটে ছুরিকাঘাত করে। তখন ইকবালের প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।
ইকবালের মা আমেনা বেগম বলেন, তারপর থেকে অপ্রকৃতস্থ ইকবাল। তার চলাফেরার কারণে বিভিন্ন সময় চুরির অপবাদে তাকে স্থানীয়রা মারধর করতো বলে আক্ষেপ করতো। ভালো ক্রিকেটও খেলতে পারতো ইকবাল।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ইকবাল মাদক সেবনের পাশাপাশি টুকটাক মাদক বিক্রি করতেন। অপ্রকৃতস্থ হলে তিনি মাদক বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতো না। এ ঘটনায় কারও ইন্ধন থাকতে পারে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইকবালের পরিবার স্থানীয় ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ সোহেলের মালিকানাধীন বস্তি এলাকায় ভাড়া থাকে। তাদের নানা কাজে সহায়তা করতেন কাউন্সিলর।
পুলিশ বলছে, কাউন্সিলরের এক ভাতিজার সঙ্গে ইকবালের ঘনিষ্ঠতা আছে। সেও মাদকসেবী। ইকবাল রঙয়ের কাজ করতো। মাঝে মধ্যে নির্মাণ কাজের সহযোগী হিসেবেও কাজ করতো।
বুধবার ৯৯৯-এ কল করেন ইকরাম হোসেন (৩০)। ইকরাম নগরীর কাশারিপট্টির রিকশাচালক বিল্লাল হোসেনের ছেলে। ইকরাম বিবাহিত হলেও উগ্র ও মাদকাসক্ত হওয়ায় স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব রয়েছে। তিনি পাইপ মিস্ত্রির কাজ করে। মঙ্গলবার রাতে ইকরাম ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে যায়। সারারাত বাইরে থাকে সে। বুধবার সকালে নানুয়ার দিঘির পাড়ে গিয়ে ৯৯৯-এ কল করে ইকরাম। তারপর পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়। সিসিটিভি ফুটেজে ইকবাল মসজিদে যাওয়ার দুই মিনিট পর ইকরামকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়।
একটি সূত্রে জানা যায়, ইকরামকে পুলিশ ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর থেকে পুলিশ হেফাজতে ছিলেন তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইকরাম সিটি মেয়রপন্থী রাজনীতি করে। কুমিল্লার একটি অভিজাত মার্কেটের নাতির সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। ওই ব্যক্তিও মাদকসেবী। পুলিশ সবগুলো ঘটনার হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছে।
ইকরামের মা সেলিনা আক্তার জানান, স্থানীয় বখাটেদের সঙ্গে মিশে আমার ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে।
গত ১৩ অক্টোবর নগরীর নানুয়ার দিঘির পাড়ের একটি অস্থায়ী পূজামণ্ডপে হনুমানের মূর্তির ওপর কোরআন শরিফ রাখার খবর ছড়িয়ে পড়লে কুমিল্লাসহ সারাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় চাঁদপুরে পাঁচজন, নোয়াখালীতে দুইজন ও কুমিল্লায় একজনের প্রাণহানি ঘটে।