কিছু কারখানা চলবেই, বেতন ১৬ এপ্রিলের মধ্যে
নভেল করোনাভাইরাস মহামারী ছড়ানো ঠেকাতে যানবাহন ও অফিস-আদালত বন্ধ করে সারা দেশকে লকডাউনের মধ্যে রাখলেও এখনই সব কারখানা বন্ধ করতে চায় না সরকার।
বরং জরুরি ক্রয়াদেশ মেটাতে ও নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী সরঞ্জাম তৈরির জন্য কিছু কারখানা কড়া নজরদারির মধ্যে খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মুখ্য সচিবের আহমেদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের এক জরুরি সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং পোশাক শিল্প মালিকদের নেতারা জানিয়েছেন।
তবে যারা কারখানা চালু রাখতে তাদেরকে কারখানা চালুর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিল্প মালিক সমিতি, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পুলিশকে অবহিত করতে হবে। কলকারখানা অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সরকারি দপ্তর তালিকা ধরে ধরে এসব কারখানায় করোনাভাইরাস চলাকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা খতিয়ে দেখবেন।
এবিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অনেক কারখানায় জরুরি আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ রয়েছে, আবার অনেক কারখানা মাস্ক, পিপিইসহ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জরুরি চিকিৎসা সামগ্রি তৈরি করছেন।
“বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মালিক সমিতিকে কারখানাগুলোর ক্রয়াদেশ ও কাজ বিশ্লেষণ করে অনুমতি দিতে বলা হয়েছে। অনুমতি পাওয়া কারখানাগুলোর নাম, শ্রমিক সংখ্যা ও কাজের ধরণসহ একটি তালিকা কলকারখানা অধিদপ্তরে জমা দিতে বলা হয়েছে।”
তবে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কোনো তালিকা হাতে পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু তাদের নিজেদের অনুসন্ধানে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য ১২৫ থেকে ১৫০ কারখানা খোলা রয়েছে।
“কারখানা চলমান থাকা অবস্থায় সেখানে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি পরিদর্শন করা হচ্ছে। শ্রমিকদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা, বাধ্যতামূলক মাস্ক পরানো, হাত পরিষ্কার রাখার জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম কারখানায় রাখা হচ্ছে কিনা পরিদর্শনে তা খতিয়ে দেখছেন কর্মকর্তারা,” বলেন শিবনাথ।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক শেষে সোমবার রাতে পোশাক শিল্প মালিকদের দুই শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সরকারের ছুটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
“তবে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর যাদের জরুরি রপ্তানি কার্যাদেশ রয়েছে এবং যে সব প্রতিষ্ঠান পিপিই, মাস্ক ইত্যাদি তৈরি করছে সেসব প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনে খোলা রাখতে পারবে। তবে সে ক্ষেত্রে স্ব স্ব অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ/বিকেএমইএ), কল কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পুলিশকে অবহিত করতে হবে।”
মঙ্গলবার ডিজাইনটেক্স নামের একটি পোশাক কারখানায় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে প্রায় আড়াই হাজার কর্মীর মার্চ মাসের বেতন বিতরণ করা হয়।
এছাড়া দুই সমিতির সদস্য কারখানা মালিকদেরকে ১৬ এপ্রিলের মধ্যে শ্রমিক-কর্মচারীদের মার্চ মাসের বেতন পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করা হয় দুই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তিতে।বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর জনসংযোগ দলের সমন্বয়ক খান মনিরুল আলম শুভ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে সব কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে যারা হাতে হাতে বেতন দিয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে একটু বিলম্ব হতে পারে।
“আমরা সদস্যদেরকে বলেছি, ১৪ তারিখের পর কারখানা খোলার সাথে সাথেই যেন শ্রমিকের হাতে বেতনের টাকা তুলে দেওয়া হয়।”
এর মধ্যে অনেক কারখানা ব্যাংক একাউন্ট ও বিকাশের মাধ্যমে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করেছে বলে তিনি দাবি করেন।
বেতন বিলম্বে দেওয়ার প্রসঙ্গে একই ধরনের ব্যাখ্যা দেন বিকেএমইএর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলভ চৌধুরী।
তিনি বলেন, “বিকেএমইএ এর ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেমকে বেতনের বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
তবে দুই সমিতির অধীনে কতটি কারখানা বেতন পরিশোধ করেছে তার সংখ্যা জানা যায়নি।
নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে বাড়িতে অবস্থানে বাধ্য করছে সরকার। এই পরিস্থিতিতেও কিছু পোশাক কারখানা চালু থাকায় তাতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে।
কিছু কারখানা প্রথম দফায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণার পর আবার কারখানা চালুর উদ্যোগ নেয়। ফলে কর্মস্থল ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া শ্রমিকরা লকডাউন অবস্থায় বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে শত শত কিলোমিটার দূরের গন্তব্য থেকে কর্মস্থলে রওনা হন। এই দৃশ্য দেখে সারা দেশে সরকার ও পোশাক মালিকদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠে। ওই রাতেই দুই সংগঠনের পক্ষ থেকে আবার সরকার ঘোষিত ছুটি পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখতে মালিকদের অনুরোধ জানানো হয়।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ শুরু থেকেই বলে আসছে কারখানা বন্ধ ঘোষণার এখতিয়ার তাদের নেই। তারা কারখানার মালিকদের বন্ধ রাখার অনুরোধ জানাতে পারেন। কারখানার মালিক ও সরকার চাইলে কারখানা বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু সরকার শুরু থেকেই কারখানা বন্ধের বিষয়টি মালিকদের উপর ছেড়ে দেয়।
সোমবারও ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহ এলাকায় কিছু কারখানা চালু ছিল বলে শ্রমিকরা জানিয়েছেন।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কারখানা মালিকের?
ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার খোলা থাকা কলকারখানাগুলোকে বিশেষ নজরদারির সিদ্ধান্ত নিলেও কারখানা চালু বা বন্ধের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়ভারটি এখনও সংশ্লিষ্ট কারখানা মালিকের কাছেই থাকবে।
অর্থাৎ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে সরকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে রেখে সংশ্লিষ্ট মালিক সমিতির উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক জানান।
তবে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক আগের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেকে বলেন, “আমরা কারখানা খোলা রাখার কোনো অনুমোদন দিচ্ছি না।
“সার্কুলারে পরিস্কার উল্লেখ রয়েছে যে, সদস্য কারখানাগুলো আমাদেরকে তাদের খোলা রাখার বিষয়টি অবগত করবে, যাতে করে আমরা জানতে পারি আমাদের কতগুলো কারখানা খোলা আছে এবং তারা কল কারখানা অধিদপ্তরের দেওয়া গাইডলাইন অনুসরণ করে কাজ করছে কিনা। এক্ষেত্রে কারখানা নিজ নিজ রপ্তানি আদেশের গুরুত্ব বুঝে খোলা বা বন্ধ রাখতে পারে। আমরা সদস্যদের কাছে জানতে চেয়েছি কারা কারখানা খোলা রাখতে চান। আমরা এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি।”
সংকটের শুরু থেকেই সরকারের দিক-নির্দেশনা অনুসরণ করে, কল কারখানা অধিদপ্তরের গাইডলাইন অনুসরণ করে শুধুমাত্র যে সকল কারখানা পিপিই তৈরি করছে অথবা যাদের জরুরি শিপমেন্ট রয়েছে তাদের কাজ চালু রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
রুবানা বলেন, “বিভিন্ন সময়ে সরকার প্রদত্ত দিক নির্দেশনা অনুসরণ করেই আমরা আমাদের সদস্য কারখানাগুলোকে জরুরি রপ্তানি কাজ ব্যতীত বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছি। তবে কারখানা বন্ধ করার কোনো আইনি কর্তৃত্ব বিজিএমইএ রাখে না, এই কর্তৃত্ব শুধুমাত্র সরকারের কাছেই ন্যস্ত।”
বিজিএমইএর সদস্য ভূক্ত ৩২শ এবং বিকেএমইএর সদস্যভূক্ত ২২শ পোশাক তৈরির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করছে। দেশের প্রধান এই রপ্তানি খাত দেশের মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮৫ শতাংশ আসে।