করোনা: হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ
করোনাকালে হাসপাতাল থেকে রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া, অবহেলায় মৃত্যু, আইসিইউ বণ্টন, বেসরকারি হাসপাতাল অধিগ্রহণ, অক্সিজেন সরবরাহ ও ঢাকা সিটি লকডাউন নিয়ে কয়েক দফা নির্দেশনা ও অভিমত দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে এ আবেদন করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার (১৬ জুন) এ তথ্য জানিয়েছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। এর আগে পাঁচটি রিটের শুনানি নিয়ে সোমবার (১৫ জুন) বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের ভার্চ্যুয়াল আদালত এ সংক্রান্ত আদেশ দিয়েছিলেন।
সার্বিক বিবেচনায় আদালতের নির্দেশনা ও অভিমত:
এক. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জারি করা নির্দেশনা (সরকারি/বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের ফিরিয়ে না দেওয়া সংক্রান্ত) যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কি-না এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন আগামী ৩০ জুনের আগে আদালতে দাখিলের জন্য সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহাপরিচালক এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।
দুই. নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি-না, প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করতে হবে।
তিন. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২৪ মে জারি করা নির্দেশনা অনুসারে ওই তারিখের পর ৫০ শয্যার অধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ১৫ জুন পর্যন্ত কতজন কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীর চিকিৎসার দেওয়া হয়েছে, সে সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ৩০ জুনের আগে জমা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে। একইসঙ্গে ৫০ শয্যার অধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের একটি তালিকা পাঠাতে হবে।
চার. বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক যথাযথভাবে প্রতিপালন করছে কি-না, সে বিষয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে ১৫ দিন পরপর একটি প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে। আবার ওইসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৫ দিন পরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে আদালতে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।
পাঁচ. বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের, বিশেষত ঢাকা মহানগর ও জেলা, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলাসহ বিভাগীয় শহরের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক যাতে কোভিড-১৯ এবং নন-কোভিড রোগীকে পরিপূর্ণ চিকিৎসাসেবা দেয় সে বিষয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।
ছয়. কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ কোনো রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিতে অনিহা দেখালে এবং এতে ওই রোগীর মৃত্যু ঘটলে ‘তা অবহেলাজনিত মৃত্যু’ হিসেবে বিবেচিত অর্থাৎ ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে বিবেচিত হবে। দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা যথাযথভাবে দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।
সাত. কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম অধিকতর জবাবদিহিমূলক ও বিস্তৃত করতে হবে। ভুক্তভোগীরা যাতে এ সেবা দ্রুত ও সহজভাবে পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। কোন হাসপাতালে আইসিইউতে কতজন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং কতটি আইসিইউ শয্যা, কী অবস্থায় আছে, তার আপডেট প্রতিদিনের প্রচারিত স্বাস্থ্য বুলেটিন এবং অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। আইসিইউ ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং সেলে ভুক্তভোগীরা যাতে সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন, সেজন্য আলাদাভাবে ‘আইসিইউ হটলাইন’ নামে হটলাইন চালু এবং হটলাইন নম্বরগুলো প্রতিদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষত টেলিভিশন মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
আট. আইসিইউয়ে চিকিৎসাধীন কোভিড-১৯ রোগী চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মাত্রাতিরিক্ত বা অযৌক্তিক ফি আদায় না করতে পারে, সে বিষয়ে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
নয়. অক্সিজেন সিলিন্ডারের খুচরা মূল্য এবং রিফিলিংয়ের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে। খুচরা বিক্রেতাদের সিলিন্ডারের নির্ধারিত মূল্য প্রতিষ্ঠান/দোকানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃত্রিম সংকট রোধে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও রোগীর পরিচয়পত্র ব্যতীত অক্সিজেন সিলিন্ডারের খুচরা বিক্রি বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করতে পারে। অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ ও বিক্রয় ব্যবস্থা মনিটরিং জোরদার করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।
দশ. সরকার ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে বিভক্ত করে পর্যায়ক্রমে লকডাউনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। এমতাবস্থায় বর্তমান পর্যায়ে লকডাউনের বিষয়ে কোনো আদেশ দেওয়া সঙ্গত হবে না মর্মে আদালত মনে করে।
এগারো. দেশে বিদ্যমান সামগ্রিক পরিস্থিতি অর্থাৎ বর্তমানে দেশে বিরাজমান করোনা পরিস্থিতি একটি ‘দুর্যোগ’ বিবেচনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গৃহীত কার্যক্রমের পাশাপাশি সরকার ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-২০১২ এর ধারা-১৪ অনুসারে ‘ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অরডিনেশন গ্রুপ’ এর কার্যক্রমকে সক্রিয় করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারে। ওই কমিটি কার্যকর হলে সুপারিশের আলোকে উপরোক্ত আইনের ধারা-২৬ অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক রিকুইজিশন করা যেতে পারে।
মন্ত্রিপরিষদ, স্বাস্থ্যসেবা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতি এসব আদেশ দেওয়া হয়েছে।
যেসব রিট আবেদনের পর এসব আদেশ দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো:
রিট-১
ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-২০১২ এর ধারা ২৫ ও ২৬ এর বিধান মতে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ রিকুইজিশন ও ‘সেন্ট্রাল বেড ব্যুরো’ স্থাপনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে রোগীদের জরুরি সেবা ও শয্যা সমস্যা সমাধানে নির্দেশনা প্রার্থনা করে রিট করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন।
রিট-২, ৩, ৪
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য বিভাগ জারি করা ১১ মে’র দু’টি স্মারকের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্পর্কিত এবং ২৪ মে জারি করা স্মারক যাতে ৫০ শয্যা ও তদূর্ধ্ব শয্যা বিশিষ্ট সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থা চালুর নির্দেশনা বাস্তবায়িত না করার নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ এবং ওই জারি করা নির্দেশনা বাস্তবায়নের নির্দেশনা প্রার্থনা করে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এএম জামিউল হক, মো. নাজমুল হুদা, মোহাম্মাদ মেহেদী হাসান, ব্যারিস্টার একেএম এহসানুর রহমান, আইনুন্নাহার সিদ্দিকা এবং জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশনের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলন।
রিট-৫
রাজধানী ঢাকায় আগামী দুই সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা এবং লকডাউন করা এলাকার জনগণকে সব ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট ও করোনা আক্রান্ত রোগীদের ‘হাই প্রোনেজাল ক্যানোলা’ সরবরাহ নিশ্চিত করার নির্দেশনা প্রার্থনা করে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহবুবুল ইসলাম।