করোনা পরিস্থিতি: মহামারির ইতিহাস ও তথ্য গোপণ সংকট
ডাঃ ফারুকুজ্জামান
করোনা পরিস্থিতি:
অধিকাংশ ভাইরাসই তার জিনগত বা কাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করে, নতুন রূপ নিতে সক্ষম। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের সম্পূর্ণ নতুন কিছু ধরণ মানবদেহে রোগ সংক্রমণ করছে (COVID-19), যা বিশ্বব্যাপী মহামারী রূপ ধারণ করেছে। কারণ, করোনা ভাইরাসের এই রোগটি একটি সংক্রমণ ব্যাধি। করোনা ভাইরাসের এই ধরণটি সম্পূর্ণ নতুন বিধায়, এখনো পর্যন্ত আমাদের হাতে কার্যকরী সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক নেই। আক্রান্ত রোগীর উপসর্গের চিকিৎসা করা এবং রোগের সংক্রমণ প্রতিহত করাই এখন আমাদের একমাত্র অস্ত্র।
তথ্য গোপণ সংকট:
বর্তমান পরিস্থিতিতে, আতঙ্ক বিরাজ করছে সর্বত্রই। অতি সঙ্গত কারণে চিকিৎসক, রোগী, স্বাস্থ্যকর্মী, সাধারণ জনগণ সবার মধ্যে এক ধরণের ভয় আর হতাশা কাজ করছে। অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালই যে কারণে তাদের সেবার পরিধি গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। সাধারণ সেবা, ইমার্জেন্সি সেবা, এমনকি ক্যান্সার চিকিৎসাও বেঁধে ফেলতে হয়েছে সীমিত পরিসরের ছকে। লক্ষ্য একটাই, সংক্রমণ প্রতিহত করা। এর মধ্যে আরো একটা সমস্যা তীব্র হতে শুরু করেছে, তা হলো “তথ্য গোপণ”।
সঙ্গত কারণ ও প্রেক্ষাপট:
সংক্রমণ আতংকে COVID-19 positive রোগীর প্রতি আছে সামাজিক ভয়, এড়িয়ে চলার প্রবণতা। আছে হাসপাতালে ভর্তি হতে প্রতিবন্ধকতা। তার যথোপযুক্ত কারণও আছে। রোগীদের কাছে সঠিক তথ্য-ধারণা না থাকায় (সন্দেহযুক্ত রোগীরা কোথায় গেলে সুচিকিৎসা পাবেন সেই ব্যাপারে), অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা তথ্য গোপণ করে সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসা নেবার চেষ্টা করছেন। আক্রান্ত হচ্ছে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী সহ, হাসপাতালে অবস্থানরত অন্যান্য সাধারণ রোগীরা। যাদের থেকে পুনরায় সংক্রমণ হচ্ছে অন্যদের মধ্যে। এ সমস্যায় ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে হাসপাতালের সাধারণ সেবার পরিসর। বিষয়টি আমলে নিয়ে আইন প্রয়োগের চেষ্টা চলছে। কিন্তু আইন করে এই সমস্যার সমাধান দুরূহ, যদি না আমরা নিজেরা সাবধান হই । সমস্যাটা আমাদের, তাই সমাধানের শুরুটা আমাদের থেকে হওয়া জরুরি।
সংক্রমণের তৃতীয় পর্যায়:
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, আমরা এই মুহূর্তে এ ভাইরাস সংক্রমণের তৃতীয় পর্যায়ে আছি। এই অবস্থা বিরাজ করবে কমপক্ষে আরো কয়েক সপ্তাহ, এমনকি মাস। এ পর্যায়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এই কারণে যে, এই পর্বেই ভাইরাসটি সংক্রমণের ঝুঁকি সবথেকে বেশি ।
মহামারির ইতিহাস:
১) “করোনা সংকট”-এর মতো মহামারি, বিশ্বে এই প্রথম নয় । প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু, এভিয়ান ফ্লু, H1N1 সোয়াইন ফ্লু এসব রোগ দিয়ে আগেও মহামারি হয়েছে বিশ্বে। নিয়ে যাচ্ছি, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সনে। আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে। “Circa সংকট”, যা চীনের কোনো এক গ্রামে শুরু হয়। মারা যায় অসংখ্য মানুষ। মৃত আক্রান্ত ব্যক্তিদের লাশগুলোকে অনেক স্থানে বাড়ির নিচে গভীর গর্ত করে রাখা হয় ও পরে পুড়িয়ে মাটি চাপা দেওয়া, সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য। বিভিন্ন “আর্কিওলজিক” গবেষণায় পরবর্তীতে তা প্রমাণিত হয়।
২) এরপর এথেন্স l খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০, প্লেগ মহামারিতে মারা যায় কমপক্ষে ১০০০০০ মানুষ। ১৬৫ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া “Antonine প্লেগে’ (যা আসলে ছিল এক ধরণের গুটি বসন্ত) রোমে মারা যায় প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষ । পৃথিবীর ইতিহাস বলছে, এরপর শুধুমাত্র প্লেগ রোগটিই কমপক্ষে ১০ বার মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। মারা গিয়েছে অজস্র মানুষ। অন্য মহামারির কথা না হয় বাদই দিলাম।
গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, এসব মহামারি কোনোটাই কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।কিন্তু তার সম্ভব্য কারণগুলো কি ছিল? তখনও আমাদের হাতে এসব মহামারি মোকাবেলা করার মতো, জীবন রক্ষাকারী সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধকও ছিল না ।
কিছু আশার বাণী:
চলুন জানি “Immunology“-এর মহামারি সংক্রান্ত্র সম্ভব্য কিছু বিশ্লেষণ:
ক) জীবাণুঘটিত কোনো রোগ মানব দেহকে আক্রান্ত করলে, তার বিরুদ্ধে শরীরে স্বাভাবিকভাবে, ঐ জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রাথমিক “এন্টিবডি” তৈরী হয় (Primary Immune Response)।
খ) পরবর্তীতে ঐ জীবাণু দিয়ে আবার সংক্রমণ হলে, আগের থেকে অনেক বেশি পরিমানে ও শক্তিশালী “এন্টিবডি” তৈরী হয় (Secondary Immune Response-Memory effect)।
গ) কোনো কোনো সংক্রমণের একটা নির্দিষ্ট সময় পর, জীবন রক্ষাকারী Community Acquired “Herd Immunity” তৈরী হয়।
সম্ভবনার কথা:
করোনার ক্ষেত্রেও একটা সুনির্দিষ্ট সময় পর, এধরণের সম্ভবনা অতি প্রকট। যখন সংক্রমণের মাত্রা প্রাকৃতিক নিয়মে এমনিতেই কমে যাবে (যদি আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক বের করতে সক্ষম নাও হই, তবুও)। কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সেই পযন্ত সংক্রমণের মাত্রা প্রতিহত করা, নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা (যাতে করে মৃত্যুর হার কমানো যায়)। সর্বোপরি আমাদের অসমাপ্ত লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া।
আল্লাহপাক আমাদের সহায় হোন ।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল